পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ما ۹ হার হয়, এইজন্য অনুপস্থিতকে উপমাস্থলে রাখিয়া জয়পতাকা গৃহিণী আপন গৃহের মধ্যেই আচল করিলেন । হরিভাবিনী । ইহারা আসিয়াছেন, তা বেশ হইয়াছে, কিন্তু আমাদের নতুন বাড়ির তো মেরামত শেষ হয় নাই— এখানে আমরা কোনোমতে মাথা গুজিয়া আছি- ইহাদের যে কষ্ট হইবে। বাজারে চক্রবর্তীর একটা ছোটাে বাড়ি মেরামত হইতেছে বটে, কিন্তু সেটা একটা দোকান ; সেখানে বাস করিবার কোনো সুবিধাও নাই, সংকল্পও নাই। চক্রবর্তী এই মিথ্যার কোনো প্রতিবাদ না করিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, “মা যদি কষ্টকে কষ্ট জ্ঞান করিবেন তবে কি উহাকে এ ঘরে আনি ? (স্ত্রীর প্রতি) যাই হউক, তুমি আর বাহিরে দাড়াইয়ো না— শরৎকালের রৌদ্রটা বড়ো খারাপ ।” এই বলিয়া চক্রবর্তী রমেশের নিকট বাহিরে চলিয়া গেলেন । হরিভাবিনী কমলার বিস্তারিত পরিচয় লইতে লাগিলেন। “তোমার স্বামী বুঝি উকিল ? তিনি কতদিন কাজ করিতেছেন ? তিনি কত রোজগার করেন ? এখনো বুঝি ব্যাবসা আরম্ভ করেন নাই ? তবে চলে কী করিয়া ? তোমার শ্বশুরের বুঝি সম্পত্তি আছে ? জান না ? ওমা, কেমন মেয়ে গো ! শ্বশুরবাড়ির খরর রাখ না ? সংসার-খরচের জন্য স্বামী তোমাকে মাসে কত করিয়া দেন ? শাশুড়ি যখন নাই তখন তো সংসারের ভার নিজের হাতেই লইতে হইবে । তুমি তো নেহাত কচি মেয়েটি নও— আমার বড়ো জামাই যা-কিছু রোজগার করে সমস্তই বিধুর হাতে গনিয়া দেয়” ইত্যাদি প্রশ্ন ও মন্তব্যের দ্বারা অতি অল্পকালের মধ্যেই কমলাকে অর্বাচীন প্ৰতিপন্ন করিয়া দিলেন । কমলাও যে রমেশের অবস্থা ও ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে কত অল্প জানে এবং তাঁহাদের সম্বন্ধ বিচার করিলে এই অল্পজ্ঞান যে কত অসংগত ও লোকসমাজে লজােকর, হরিভাবিনীর প্রশ্নমালায় তাহা তাহার মনে স্পষ্ট উদয় হইল । সে ভাবিয়া দেখিল, আজ পর্যন্ত রমেশের সঙ্গে ভালো করিয়া কোনো কথা আলোচনা করিবার অবকাশমাত্র সে পায় নাই— সে রমেশের স্ত্রী হইয়া রমেশের সম্বন্ধে কিছুই জানে না। আজ ইহা তাহার নিজের কাছে অদ্ভুত বােধ হইল এবং নিজের এই অকিঞ্চিৎকরত্বের লজ্জা তাহাকে পীড়িত করিয়া তুলিল । হরিভাবিনী আবার শুরু করিলেন, “বউমা, দেখি তোমার বালা । এ সোনা তো তেমন ভালো নয় । বাপের বাড়ি হইতে কিছু গহনা আন নাই ? বাপ নাই ? তাই বলিয়া কি এমন করিয়া গা খালি রাখে ? তোমার স্বামী বুঝি কিছু দেন নাই ? আমার বড়ো জামাই দুই মাস অন্তর আমার বিধুকে একখানা করিয়া গহনা গড়াইয়া দেয় ।” এই সমস্ত সওয়াল-জবাবের মধ্যে শৈলজা তাহার দুই বৎসর বয়সের কন্যার হাত ধরিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। শৈলজা শ্যামবর্ণ, তাহার মুখখানি ছোটােখাটাে, মুষ্টিমেয়, চোখ-দুটি উজ্জ্বল, ললাট প্রশস্ত- মুখ দেখিলেই স্থির বুদ্ধি এবং একটি শান্ত পরিতৃপ্তির ভাব চােখে পড়ে। শৈলজার ছােটাে মেয়েটি কমলার সম্মুখে দাড়াইয়া মুহুর্তকাল পর্যবেক্ষণের পর বলিয়া উঠিল "মাসি”— বিধুর সঙ্গে সাদৃশ্য বিচার করিয়া যে বলিল তাঁহা নহে, একটা বিশেষ বয়সের যে-কোনো মেয়েকে তাহার অপ্ৰিয় বোধ না হইলেই তাহাকেই সে নির্বিচারে মাসি নামে অভিহিত করে । কমলা তৎক্ষণাৎ তাহাকে কোলে তুলিয়া লইল । করিতে বাহির হইয়াছেন। পথে কর্তার সঙ্গে দেখা হইয়াছিল, তিনি ইহাদের গাজিপুরে আনিয়াছেন।” শৈলজা কমলার মুখের দিকে চাহিল, কমলাও শৈলজার মুখের দিকে চাহিল, এবং সেই দৃষ্টিপাতেই এক মুহুর্তে উভয়ের সখ্যবন্ধন বাধিয়া গেল। হরিভাবিনী আতিথ্যের আয়োজনে চলিয়া গেলেন ; শৈলজা কমলার হাত ধরিয়া কহিল “ এসো ভাই, আমার ঘরে এসো ।” অল্পক্ষণের মধ্যেই দুজনে ঘনিষ্ঠভাবে কথা আরম্ভ হইল। শৈলজার সঙ্গে কমলার বয়সের যে