পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sዔbr রবীন্দ্র-রচনাবলী \OR একটু ফাঁকা জায়গায় গঙ্গার ধারে একটা আলাদা বাড়ি লইবার চেষ্টা হইতেছে। রমেশ গাজিপুর-আদালতের বিধি-অনুসারে প্রবেশ লাভ করিবার জন্য ও জিনিসপত্র আনিতে একবার কলিকাতায় যাইতে হইবে স্থির করিয়াছে, কিন্তু কলিকাতায় যাইতে তাহার সাহস হইতেছে না । কলিকাতার একটা বিশেষ গলির চিত্ৰ মনে উঠিলেই রমেশের বুকের ভিতরটা এখনো যেন কিসে চাপিয়া ধরে। এখনাে জাল ছেড়ে নাই, অথচ কমলার সহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করিয়া লইতে বিলম্ব করিলে আর চলে না । এই সমস্ত দ্বিধায় কলিকাতায় যাত্রার দিন পিছাইয়া যাইতে লাগিল । কমলা চক্রবর্তীর অন্তঃপুরেই থাকে। এ বাংলায় ঘর নিতান্ত কম বলিয়া রমেশকে বাহিরের ঘরেই থাকিতে হয়; কমলার সহিত তাহার সাক্ষাতের সুযোগ হয় না। এই অনিবাৰ্য বিচ্ছেদব্যাপার লইয়া শৈলজা কেবলই কমলার কাছে দুঃখপ্রকাশ করিতে লাগিল । কমলা কহিল, “কেন ভাই, তুমি এত হাহুতাশ করিতেছ ? এমনি কী ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে!” শৈলজা হাসিয়া কহিল, “ইস, তাই তো ! একেবারে যে পাষাণের মতো কঠিন মন । ও-সব ছলনায় আমাকে ভুলাইতে পারবে না। তােমার মনের মধ্যে যে কী হইতেছে সে কি আর আমি জানি না। " नीं ( उ शंशे6ल दि ऊठप्रशान्-ि” শৈলজা সগর্বে কহিল, “ইস, দুই দিন দেখা না দিয়া তার নাকি থাকিবার জো আছে!” এই বলিয়া বিপিনবাবুর অধৈৰ্য সম্বন্ধে শৈলজা গল্প করিতে লাগিল। প্রথম-প্রথম বিবাহের পর বালক বিপিন গুরুজনের বৃহভেদ করিয়া তাহার বালিকাবধুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য কবে কতপ্রকার কৌশল উদভাবন করিয়াছিল, কবে ব্যর্থ হইয়াছিল, কবে ধরা পড়িয়াছিল, দিবাসীক্ষাৎকারের নিষেধদুঃখ-লাঘবের জন্য বিপিনের মধ্যাহ্নভোজনকালে একটা আয়নার মধ্যে গুরুজনদের অজ্ঞাতে উভয়ের কিরূপ দৃষ্টি-বিনিময় চলিত, তাহা বলিতে বলিতে পুরাতন স্মৃতির আনন্দকৌতুকে শৈলজার মুখখানি হাস্যে উদভাসিত হইয়া উঠিল। তাহার পরে যখন আপিসে যাইবার পালা আরম্ভ হইল, তখন উভয়ের বেদনা এবং বিপিনের যখন-তখন আপিস-পলায়ন, সেও অনেক কথা। তাহার পরে একবার শ্বশুরের ব্যবসায়ের খাতিরে কিছুদিনের জন্য বিপিনের পাটনায় যাইবার কথা হয়, তখন শৈলজা তাহার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘তুমি পাটনায় গিয়া থাকিতে পরিবে ? বিপিন স্পর্ধা করিয়া বলিয়াছিল, "কেন পারিব না, খুব পারিব।” সেই স্পর্ধাবাক্যে শৈলজার মনে খুব অভিমান হইয়াছিল ; সে প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, বিদায়ের পূর্বরাত্রে সে কোনােমতে লেশমাত্র শোকপ্রকাশ করিবে না ; কেমন করিয়া সে প্রতিজ্ঞা হঠাৎ চোখের জলের প্লাবনে ভাসিয়া গেল এবং পরদিনে যখন যাত্রার আয়োজন সমস্তই স্থির তখন বিপিনের অকস্মাৎ এমনি মাথা ধরিয়া কী-এক-রকমের অসুখ করিতে লাগিল যে যাত্রা বন্ধ করিতে হইল, তাহার পরে ডাক্তার যখন ওষুধ দিয়া গেল, তখন সে ওষুধের শিশি গোপনে নর্দমার মধ্যে শূন্য করিয়া অপূর্ব উপায়ে কী করিয়া ব্যাধির অবসান হইল— এ-সমস্ত কাহিনী বলিতে বলিতে কখন যে বেলা অবসান হইয়া আসে, শৈলজার তাহাতে ইহঁশ থাকে না- অথচ এমন সময় হঠাৎ দূরে বাহির-দরজায় একটা কিসের শব্দ হয়-কি-না-হয় অমনি শৈল ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়ে। বিপিনবাবু আপিস হইতে ফিরিয়াছেন। সমস্ত গল্পহাসির অন্তরালে একটি উৎকণ্ঠিত হৃদয় সেই পথের ধারের বাহির-দরজার দিকেই কান পাতিয়া বসিয়া ছিল । কমলার কাছে এ-সমস্ত কথা যে একেবারেই আকাশকুসুমের মতো তাহা নয় ; ইহার আভাস সে কিছু-কিছু পাইয়াছে। প্রথম কয়েক মাস রমেশের সহিত প্রথম-পরিচয়ের রহস্যের মধ্যে যেন এই রকমেরই একটা রাগিণী বাজিয়া উঠিতেছিল। তাহার পরেও ইস্কুল হইতে উদ্ধারলাভ করিয়া কমলা