পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sbr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকিবার আর-কোনো ছুতা থাকিল না। এতদিন পরে কমলা নিজের স্বাধীন ঘরকন্নার মধ্যে প্রবেশ कळ्नि । বাংলাটির চারি দিকে বাগান করিবার মতো জমি যথেষ্ট আছে। দুই সারি সুদীর্ঘ সিসুগাছের ভিতর দিয়া একটি ছায়াময় রাস্তা গেছে। শীতের শীর্ণ গঙ্গা বহুদূরে সরিয়া গিয়া বাড়ি এবং গঙ্গার মাঝখানে একটি নিচু চর পড়িয়াছে— সেই চরে চাষীরা স্থানে স্থানে গোধূম চাষ করিয়াছে এবং স্থানে স্থানে তরমুজ ও খরমুজ লাগাইতেছে। বাড়ির দক্ষিণ-সীমানায় গঙ্গার দিকে একটি বৃহৎ বৃদ্ধ নিমগাছ আছে, তাহার তলা বাধানো | বহুদিন ভাড়াটের অভাবে বাড়ি ও জমি অনাদৃত অবস্থায় থাকতে বাগানে গাছপালা প্রায় কিছুই ছিল না এবং ঘরগুলিও অপরিচ্ছন্ন হইয়া ছিল | কিন্তু কমলার কাছে এ-সমস্তই অত্যন্ত ভালো লাগিল। গৃহিণীপদলাভের আনন্দ-আভায় তাহার চক্ষে সমস্তই সুন্দর হইয়া উঠিল। কোন ঘর কী কাজে ব্যবহার করিতে হইবে, জমির কোথায় কিরূপ গাছপালা লাগাইতে হইবে, তাহা সে মনে মনে ঠিক করিয়া লইল । খুড়ার সহিত পরামর্শ করিয়া কমলা সমস্ত জমিতে চাষ দিয়া লইবার ব্যবস্থা করিল। নিজে উপস্থিত থাকিয়া রান্নাঘরের চুলা বানাইয়া লইল এবং তাহার পার্শ্ববতী ভাড়ার-ঘরে যেখানে যেরূপ পরিবর্তন আবশ্যক তাহা সাধন করিল। সমস্ত দিন ধােওয়া-মাজা, গোছানােগাছানো- কাজকর্মের আর অন্ত নাই। চারি দিকেই কমলার মমত্ব আকৃষ্ট হইতে লাগিল । গৃহকর্মের মধ্যে রমণীর সৌন্দর্য যেমন বিচিত্র, যেমন মধুর, এমন আর কোথাও নহে। রমেশ আজ কমলাকে সেই কর্মের মাঝখানে দেখিল ; সে যেন পাখিকে খাচার বাহিরে আকাশে উড়িতে দেখিল । তাহার প্রফুল্ল মুখ, তাহার সুনিপুণ পটুত্ব রমেশের মনে এক নূতন বিস্ময় ও আনন্দের উদ্রেক করিয়া निव्न । g -- এতদিন কমলাকে রমেশ তাহার স্বস্থানে দেখে নাই ; আজ তাহাকে আপনি নূতন সংসারের শিখরদেশে যখন দেখিল তখন তাহার সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা মহিমা দেখিতে পাইল । কমলার কাছে আসিয়া রমেশ কহিল, “কমলা, করিতেছ। কী ? শ্ৰান্ত হইয়া পড়িবে যে ” কমলা তাহার কাজের মাঝখানে একটুখানি থামিয়া রমেশের দিকে মুখ তুলিয়া তাহার মিষ্টমুখের হাসি হাসিল ; কহিল, “না, আমার কিছু হইবে না।” রমেশ যে তাহার তত্ত্ব লইতে আসিল, এটুকু সে পুরস্কারস্বরূপ গ্ৰহণ করিয়া তৎক্ষণাৎ আবার কাজের মধ্যে নিবিষ্ট হইয়া গেল । মুগ্ধ রমেশ ছুতা করিয়া আবার তাহার কাছে গিয়া কহিল, “তোমার খাওয়া হইয়াছে তো কমলা ?” কমলা কহিল, “বেশ, খাওয়া হয় নাই তো কী ? কোনকালে খাইয়াছি।” রমেশ এ খবর জানিত, তবু এই প্রশ্নের ছলে কমলাকে একটুখানি আদর না জানাইয়া থাকিতে পারিল না ; কমলাও রমেশের এই অনাবশ্যক প্রশ্নে যে একটুখানি খুশি হয় নাই তাহা নহে। রমেশ আবার একটুখানি কথাবার্তার সূত্রপাত করিবার জন্য কহিল, “কমলা, তুমি নিজের হাতে কত করিবে, আমাকে একটু খটাইয়া লও-না।” কমিষ্ঠ লোকের দোষ এই, অন্য লোকের কর্মপটুতার উপরে তাঁহাদের বড়ো একটা বিশ্বাস থাকে না । তাহদের ভয় হয়, যে কাজ তাহারা নিজে না করিবে সেই কাজ অন্যে করিলেই পাছে সমস্ত নষ্ট করিয়া দেয় । কমলা হাসিয়া কহিল, “না, এ-সমস্ত কাজ তোমাদের নয় ।” রমেশ কহিল, “পুরুষরা নিতান্তই সহিষ্ণু বলিয়া পুরুষজাতির প্রতি তোমাদের এই অবজ্ঞা আমরা সহ্য করিয়া থাকি, বিদ্রোহ করি না, তোমাদের মতো যদি স্ত্রীলোক হইতাম তবে তুমুল ঝগড়া বাধাইয়া দিতাম। আচ্ছা, খুড়াকে তো তুমি খাটাইতে ক্ৰটি কর না, আমি এতই কি অকৰ্মণ্য ?” কমলা কহিল, “তা জানি না, কিন্তু তুমি রান্নাঘরে বুলি ঝাড়াইতেছ। তাহা মনে করিলেই আমার হাসি পায়। তুমি এখান থেকে সরো, এখানে ভারি ধুলা উড়াইয়াছে।” রমেশ কমলার সহিত কথা চালাইবার জন্য বলিল, “ধুলা তো লোক-বিচার করে না, ধুলা