পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি · Sbrዓ সকাল খাইয়া শুইতে যাও । শৈলকে কমলা যদি সকল কথা বলিতে পারিত তবে বঁচিয়া যাইত, কিন্তু বলিবার কথা নয় । “যাহাকে এতকাল আমার স্বামী বলিয়া জানিতাম সে আমার স্বামী নয়, এ কথা আর যাহাকে হউক, শৈলকে কোনোমতেই বলা যায় না । কমলা শোবার ঘরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া প্ৰদীপের আলোকে আর-একবার রমেশের সেই চিঠি লইয়া বসিল । চিঠি যাহাকে উদ্দেশ করিয়া লেখা হইতেছে তাহার নাম নাই, ঠিকানা নাই, কিন্তু সে যে স্ত্রীলোক, রমেশের সঙ্গে তাহার বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল ও কমলাকে লইয়াই তাহার সঙ্গে সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে, তাহা চিঠি হইতে স্পষ্টই বোঝা যায়। যাহাকে চিঠি লিখিতেছে, রমেশ যে তাহাকেই সমস্ত হৃদয় দিয়া ভালোবাসে এবং দৈবদূর্বিপাকে কোথা হইতে কমলা তাহার ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়াতেই অনাথার প্রতি দয়া করিয়া এই ভালোবাসার বন্ধন সে অগতা চিরকালের মতো ছিন্ন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, এ কথাও চিঠিতে গোপন নাই। সেই নদীর চরে রমেশের সহিত প্রথম মিলন হওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া আর এই গাজিপুরে আসা পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতি কমলা মনে মনে আবৃত্তি করিয়া লইল ; যাহা অস্পষ্ট ছিল সমস্ত স্পষ্ট হইল । রমেশ যখন বরাবর তাহাকে পরের স্ত্রী বলিয়া জানিতেছে এবং ভাবিয়া অস্থির হইতেছে যে তাহাকে লইয়া কী করিবে, তখন যে কমলা নিশ্চিন্তমনে তাহাকে স্বামী জানিয়া অসংকোচে তাহার সঙ্গে চিরস্থায়ী ঘরকন্নার সম্পর্ক পাতাইতে বসিতেছে, ইহার লজ্জা কমলাকে বার বার করিয়া তপ্তশেলে বিধিতে থাকিল। প্রতিদিনের বিচিত্র ঘটনা মনে পড়িয়া সে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে লাগিল। এ লজ্জা তাহার জীবনে একেবারে মাখা হইয়া গেছে, ইহা হইতে কিছুতেই আর তাহার উদ্ধার নাই । রুদ্ধঘরের দরজা খুলিয়া ফেলিয়া কমলা খিড়কির বাগানে বাহির হইয়া পড়িল । অন্ধকার শীতের রাত্রি, কালো আকাশ কালো পাথরের মতো কনকনে ঠাণ্ডা। কোথাও বাম্পের লেশ নাই ; তারাগুলি সুস্পষ্ট জ্বলিতেছে। সম্মুখে খর্বকার কলমের আমের বন অন্ধকার বাড়াইয়া দাড়াইয়া রহিল। কমলা কোনোমতেই কিছুই ভাবিয়া পাইল না। সে ঠাণ্ডা ঘাসের উপর বসিয়া পড়িল, কাঠের মূর্তির মতো স্থির হইয়া রহিল ; তাহার চোখ দিয়া এক ফোটা জল বাহির হইল না । এমন কতক্ষণ সে বসিয়া থাকিত বলা যায় না ; কিন্তু তীব্র শীত তাহার হৃৎপিণ্ডকে দোলাইয়া দিল, তাহার সমস্ত শরীর ঠক ঠক করিয়া কঁাপিতে লাগিল। গভীর রাত্রে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্ৰোদয় যখন নিস্তব্ধ তালবনের অন্তরালে অন্ধকারের একটি প্রান্তকে ছিন্ন করিয়া দিল তখন কমলা ধীরে ধীরে উঠিয়া ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল। সকালবেলা কমলা চোখ মেলিয়া দেখিল, শৈল তাহার খাটের পাশে দাড়াইয়া আছে। অনেক বেলা হইয়া গেছে বুঝিয়া লজ্জিত কমলা তাড়াতাড়ি বিছানার উপর উঠিয়া বসিল । শৈল কহিল, “না ভাই, তুমি উঠিয়ে না, আর একটু ঘুমাও- নিশ্চয় তোমার শরীর ভালো নাই। তোমার মুখ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে, চােখের নীচে কালি পড়িয়া গেছে। কী হইয়াছে ভাই, আমাকে বলো-না৷ ” বলিয়া শৈলজা কমলার পাশে বসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল। কমলার বুক ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, তাহার অশ্রু আর বাধা মানে না। শৈলজার কঁাধের উপর মুখ লুকাইয়া তাহার কান্না একেবারে ফাটিয়া বাহির হইল। শৈল একটি কথাও না বলিয়া তাহাকে দৃঢ় করিয়া আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। একটু পরেই কমলা তাড়াতাড়ি শৈলজার বাহুবন্ধন ছাড়াইয়া উঠিয়া পড়িল, চোখ মুছিয়া ফেলিয়া জোর করিয়া হাসিতে লাগিল । শৈল কহিল, “নাও নাও, আর হাসিতে হইবে না । ঢের ঢের মেয়ে দেখিয়াছি, তোমার মতো এমন চাপা মেয়ে আমি দেখি নাই। কিন্তু তুমি মনে করিতেছ। আমার কাছে লুকাইবে- আমাকে তেমন হাবা পাও নাই। তবে বলিব ? রমেশবাবু এলাহাবাদে গিয়া অবধি তোমাকে একখানি চিঠি লেখেন নি। তাই রাগ হইয়াছে— অভিমানিনী ! কিন্তু তোমারও বোঝা উচিত,