পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯০ | রবীন্দ্ররচনাবলী শৈল কমলার কপোলে করাঘাত করিয়া কহিল, “ইস, তাই তো ! যা-কিছু ছিল সমস্ত বুঝি একজনকে সমর্পণ করিয়া দিয়াছিস ? এটা কী বল দেখি।” বলিয়া শৈল অঞ্চলের ভিতর হইতে একটা চিঠি বাহির করিল। লেফাফায় রমেশের হস্তাক্ষর দেখিয়া কমলার মুখ তৎক্ষণাৎ পাংশুবৰ্ণ হইয়া গেল— সে একটুখানি মুখ ফিরাইল । শৈল কহিল, “ওগো, আর অভিমান দেখাইতে হইবে না, ঢের হইয়াছে। এ দিকে চিঠিখানা ছো মারিয়া লইবার জন্য মনটার ভিতরে ধড়ফড় করিতেছে- কিন্তু মুখ ফুটিয়া না চাহিলে আমি দিব না, কখনো দিব না, দেখি কতক্ষণ পণ রাখিতে পাের।” এমন সময় উমা একটা সাবানের বাক্সে দড়ি বাধিয়া টানিয়া আনিয়া কহিল, “মাসি, গা-গ।” কমলা তাড়াতাড়ি উমিকে কোলে তুলিয়া বারংবার চুমো খাইতে খাইতে শোবার ঘরে লইয়া গেল। উমি তাহার শকটচালনায় অকস্মাৎ বাধাপ্ৰাপ্ত হইয়া চিৎকার করিতে লাগিল, কিন্তু কমলা কোনোমতেই ছাড়িল না- তাহাকে ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া নানাপ্রকার প্রলাপবাক্যে তাহার মনোরঞ্জন-চেষ্টায় প্রবলবেগে প্রবৃত্ত হইল। শৈল আসিয়া কহিল, “হার মানিলাম, তোরই জিত— আমি তো পারিতাম না । ধন্য মেয়ে ! এই নে ভাই, কেন মিছে অভিশাপ কুড়াইব ?” এই বলিয়া বিছানার উপরে চিঠিখানা ফেলিয়া উমিকে কমলার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলিয়া গেল । লেফাফাটা লইয়া একটুখানি নাড়াচাড়া করিয়া কমলা চিঠিখানা খুলিল ; প্রথম দুই-চারি লাইনের উপরে দৃষ্টিপাত করিয়াই তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। লজ্জায় সে চিঠিখানা একবার ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। প্রথম ধাক্কার এই প্রবল বিতৃষ্ণার আক্ষেপ সামলাইয়া লইয়া আবার সেই চিঠি মাটি হইতে তুলিয়া সমস্তটা সে পড়িল । সমস্তটা সে ভালো করিয়া বুঝিল কি না বুঝিল জানি না ; কিন্তু তার মনে হইল যেন সে হাতে করিয়া একটা পঙ্কিল পদার্থ নাড়িতেছে। চিঠিখানা আবার সে ফেলিয়া দিল । যে ব্যক্তি তাহার স্বামী নহে। তাহারই ঘর করিতে হইবে, এইজন্য এই আহবান ! রমেশ জানিয়া শুনিয়া এতদিন পরে তাহাকে এই অপমান করিল ! গাজিপুরে আসিয়া রমেশের দিকে কমলা যে তাহার হৃদয় অগ্রসর করিয়া দিয়াছিল, সে কি রমেশ বলিয়া না তাহার স্বামী বলিয়া ? রমেশ তাঁহাই লক্ষ্য করিয়াছিল, সেইজন্যই অনাথার প্রতি দয়া করিয়া তাহাকে আজ এই ভালোবাসার চিঠি লিখিয়াছে। লাইবে- কেমন করিয়া ! এমন লজ্জা, এমন ঘূণা কমলার অদৃষ্ট কেন ঘটিল! সে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার কাছে কী অপরাধ করিয়াছে ? এবারে 'ঘর’ বলিয়া একটা বীভৎস জিনিস কমলাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে, কমলা কেমন করিয়া রক্ষা পাইবে । রমেশ যে তাহার কাছে এতবড়ো বিভীষিকা হইয়া উঠিবে, দুই দিন আগে তাহা কি কমলা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারিত ? ইতিমধ্যে দ্বারের কাছে উমেশ আসিয়া একটুখানি কাশিল । কমলার কাছে কোনো সাড়া না পাইয়া সে আস্তে আস্তে ডাকিল, “মা !” কমলা দ্বারের কাছে আসিল, উমেশ মাথা চুলকাইয়া বলিল, “মা, আজ সিধুবাবুরা মেয়ের বিবাহে কলিকাতা হইতে একটা যাত্রার দল আনাইয়াছেন।” কমলা কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই যাত্রা শুনতে যাস ।” উমেশ । কাল সকালে কি ফুল তুলিয়া আনিয়া দিতে হইবে ? কমলা। না না, ফুলের দরকার নেই। উমেশ যখন চলিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ কমলা তাহাকে ফিরিয়া ডাকিল ; কহিল, “ও উমেশ, তুই যাত্রা শুনিতে যাইতেছিস, এই নে, পাঁচটা টাকা নে ৷” উমেশ আশ্চর্য হইয়া গেল। যাত্রা শুনিবার সঙ্গে পাঁচটা টাকার কী যোগ তাহা সে কিছুই বুঝিতে পারিল না। কহিল, “মা, শহর হইতে কি তোমার জন্য কিছু কিনিয়া আনিতে হইবে ?”