পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি Ridd কমলা। না না, আমার কিছুই চাই নে। তুই রাখিয়া দে, তোর কাজে লাগিবে। হতবুদ্ধি উমেশ চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিলে কমলা আবার তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “উমেশ, তুই এই কাপড় পরিয়া যাত্রা শুনিতে যাইবি নাকি, তোকে লোকে বুলিবে কী ?” লোকে যে উমেশের নিকট সাজসজ্জা সম্বন্ধে অত্যন্ত বেশি প্রত্যাশা করে এবং ত্রুটি দেখিলে আলোচনা করিয়া থাকে, উমেশের এরূপ ধারণা ছিল না— এই কারণে ধুতির শুভ্রতা ও উত্তরচ্ছদের একান্ত অভাব সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। কমলার প্রশ্ন শুনিয়া উমেশ কিছু না বলিয়া একটুখানি কমলা তাহার দুই জোড়া শাড়ি বাহির করিয়া উমেশের কাছে ফেলিয়া দিয়া কহিল, “এই নে, যা, পরিস ।” শাড়ির চওড়া বাহারে পাড় দেখিয়া উমেশ অত্যন্ত উৎফুল্প হইয়া উঠিল, কমলার পায়ের কাছে পডিয়া ঢিপ করিয়া প্ৰণাম করিল, এবং হাস্যদমনের বৃথা চেষ্টায় সমস্ত মুখখানাকে বিকৃত করিয়া চলিয়া গেল। উমেশ চলিয়া গেলে কমলা দুই ফোটা চােখের জল মুছিয়া জানালার কাছে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল । শৈল ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “ভাই কমল, আমাকে তোর চিঠি দেখাবি নে ?” কমলার কাছে শৈলর তো কিছুই গোপন ছিল না, তাই শৈল এতদিন পরে সুযোগ পাইয়া এই দাবি করিল। কমলা কহিল, “ঐ-যে দিদি, দেখে-না৷ ” বলিয়া, মেজের উপরে চিঠি পড়িয়া ছিল, দেখাইয়া দিল। শৈল আশ্চর্য হইয়া ভাবিল, “বাস রে, এখনো রাগ যায় নাই!” মাটি হইতে শৈল চিঠি তুলিয়া লইয়া সমস্তটা পড়িল। চিঠিতে ভালোবাসার কথা যথেষ্ট আছে বটে, কিন্তু তবু এ কেমনতরো চিঠি ! মানুষ আপনার স্ত্রীকে এমনি করিয়া চিঠি লেখে ! এ যেন কী-এক-রকম ! শৈল জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছ ভাই, তোমার স্বামী কি নভেল লেখেন ?” মুঙ্গেটা শুনিয়া চৰ্বিতের মধ্যে কমলার দেহ,মন যেন সংকুচিত হইয়া গেল। সে কহিল, "७न्मि का ।' m শৈল কহিল, “তা হলে আজ তুমি বাংলাতেই যাইবে ?” কমলা মাথা নাড়িয়া জানাইল যে, যাইবে । আজ নরসিংবাবুর বউ আসিবে। মা বরঞ্চ তোমার সঙ্গে যান।” কমলা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না না, মা গিয়া কী করিবেন ? সেখানে তো চাকর আছে।” শৈল হাসিয়া কহিল, “আর তোমার বাহন উমেশ আছে, তোমার ভয় কী ?” উমা তখন কাহার একটা পেনসিল সংগ্ৰহ করিয়া যেখানে-সেখানে আঁচড় কাটিতেছিল এবং চিৎকার করিয়া অব্যক্ত ভাষা উচ্চারণ করিতেছিল, মনে করিতেছিল ‘পড়িতেছি । শৈল তাহার এই সাহিত্যরচনা হইতে তাহাকে বলপূর্বক কড়িয়া লইল ; সে যখন প্রবল তারস্বরে আপত্তি প্রকাশ করিল, কমলা বলিল, “একটা মজার জিনিস দিতেছি আয় ।” এই বলিয়া ঘরে লইয়া গিয়া তাহাকে বিছানার উপর ফেলিয়া আদরের দ্বারা তাহাকে অত্যন্ত উদবেজিত করিয়া তুলিল। সে যখন প্রতিশ্রুত উপহারের দাবি করিল। তখন কমলা তাহার বাক্স খুলিয়া একজোড়া সোনার ব্রেসলেট বাহির করিল। এই দুর্লভ খেলনা পাইয়া উমি ভারি খুশি হইল। মাসি তাহার হাতে পরাইয়া দিতেই সে সেই ঢলঢ়লে গহনাজোড়া-সমেত দুটি হাত সন্তৰ্পণে তুলিয়া ধরিয়া সগৰ্বে তাহার মাকে দেখাইতে গেল। মা ব্যস্ত হইয়া যথাস্থানে প্ৰত্যপণ করিবার জন্য ব্রেসলেট কড়িয়া লাইল ; কহিল, “কমল, তোমার কিরকম বুদ্ধি ! এসব জিনিস উহার হাতে দাও কেন ?” এই দুর্ঘ্যবহারে উমির আর্তনাদের নালিশ গগন ভেদ করিয়া উঠিল। কমলা কাছে আসিয়া কহিল, "দিদি, এ ব্রেসলেট-জোড়া আমি উমিকেই দিয়াছি।”