পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আলোচনা হইতে হইতে সূর্য অস্তমিত এবং আকাশ মলিন তাম্রবর্ণ হইয়া আসিল। চারি দিকে কলিকাতার কর্ম ও কোলাহল, তাহারই মাঝখানে একটি গলির বাড়ির ছাদের কোণে এই বৃদ্ধ ও নবীন দুটিতে মিলিয়া, পিতা ও কন্যার চিরন্তন স্নিগ্ধ সম্বন্ধটিকে সন্ধ্যাকাশের ক্ৰিয়মাণ ছায়ায় অশ্রুসিক্ত মাধুরীতে ফুটাইয়া তুলিল । এমন সময়ে সিঁড়িতে যোগেন্দ্রের পায়ের শব্দ শুনিয়া দুই জনের গুঞ্জনালাপ তৎক্ষণাৎ থামিয়া গেল এবং চকিত হইয়া দুই জনেই উঠিয়া দাড়াইলেন। যোগেন্দ্ৰ আসিয়া উভয়ের মুখের দিকে তীব্ৰদূষ্টি নিক্ষেপ করিল এবং কহিল, “হেমের সভা বুঝি আজকাল এই ছাদেই ?” যোগেন্দ্ৰ অধীর হইয়া উঠিয়ছিল। ঘরের মধ্যে দিনরাত্রি এই যে একটা শোকের কালিমা লাগিয়াই আছে, ইহাতে তাহাকে প্রায় বাড়িছাড়া করিয়াছে। অথচ বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে গেলে হেমনলিনীর বিবাহ লইয়া নানা জবাবদিহির মধ্যে পড়িতে হয় বলিয়া কোথাও যাওয়াও মুশকিল। সে কেবলই বলিতেছে, ‘হেমনলিনী অত্যন্ত বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে। মেয়েদের ইংরাজি গল্পের বই পড়িতে দিলে এইরূপ দুৰ্গতি ঘটে। হেম ভাবিতেছে— ‘রমেশ যখন আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছে তখন আমার হৃদয়- ভাঙিয়া যাওয়া উচিত, তাই সে আজ খুব সমারোহ করিয়া হৃদয় ভাঙিতে বসিয়াছে। নভেল-পড়া কয়জন মেয়ের ভাগ্যে ভালোবাসার নৈরাশ্য সহিবার এমন চমৎকার সুযোগ ঘটে ! হেমকে লইয়া একটুখানি গল্প করিতেছি।” যেন তিনিই গল্প করিবার জন্য হেমকে ছাদে টানিয়া আনিয়াছেন । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “কেন, চায়ের টেবিলে কি আর গল্প হয় না ? বাবা, তুমি-সুদ্ধ হেমকে খেপাইবার চেষ্টায় আছ। এমন করিলে তো বাড়িতে টেকা দায় হয় ।” হেমনলিনী চকিত হইয়া কহিল, “বাবা, এখনো কি তোমার চা খাওয়া হয় নাই ?” যোগেন্দ্র। চা তো কবিকল্পনা নয় যে, সন্ধ্যাবেলাকার আকাশের সূর্যস্ত-আভা হইতে আপনি ঝরিয়া পড়িবে !! ছাদের কোণে বসিয়া থাকিলে চায়ের পেয়াল ভরিয়া উঠে না, এ কথাও কি নূতন করিয়া বলিয়া দিতে হইবে । অন্নদা হেমনলিনীর লজ্জানিবারণের জন্য তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “আমি যে আজ চা খাইব না। বলিয়া ঠিক করিয়াছি।” যোগেন্দ্র । কেন বাবা, তোমরা সকলেই তপস্বী হইয়া উঠিবে নাকি ? তাহা হইলে আমার দশা কী হইবে ? বায়ু-আহারটা আমার সহ্য হয় না। অন্নদা। না না, তপস্যার কথা হইতেছে না ; কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নাই, তাই ভাবিতেছিলাম আজ চা না খাইয়া দেখা যাক কেমন থাকি । বস্তুত হেমনলিনীর সঙ্গে কথা কহিবার সময় পরিপূর্ণ চায়ের পেয়ালার ধ্যানমূর্তি অনেক বার অন্নদাবাবুকে প্রলুব্ধ করিয়া গেছে, কিন্তু আজ উঠিতে পারেন নাই। অনেক দিন পরে আজ হেম তাহার সঙ্গে সুস্থভাবে কথা কহিতেছে, এই নিভৃত ছাদে দুটিতে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আলাপ জমিয়া উঠিয়াছে, এমন গভীর-নিবিড়-ভাবে আলাপ পূর্বে তো তাহার কখনো মনে পড়ে না। এ আলাপ এক জায়গা হইতে আর-এক জায়গায় তুলিয়া লইয়া যাওয়া সহিবে না- নড়িবার চেষ্টা করিলেই ভীরু হরিণের মতো সমস্ত জিনিস ছুটিয়া পালাইবে । সেইজন্যই অন্নদাবাবু আজ চা-পাত্রের মুহুর্মুহু আহবান উপেক্ষা করিয়াছিলেন । অন্নদাবাবু যে চা-পান রহিত করিয়া অনিদ্রার চিকিৎসায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, এ কথা হেমনলিনী বিশ্বাস করিল না ; সে কহিল, “চলো বাবা, চা খাইবে চলো ।” অন্নদাবাবু সেই মুহুর্তেই অনিদ্রার আশঙ্কটা বিস্মৃত হইয়া ব্যগ্রপদেই টেবিলের অভিমুখে ধাবিত হইলেন । । - চা খাইবার ঘরে প্রবেশ করিয়াই অন্নদাবাবু দেখিলেন, অক্ষয় সেখানে বসিয়া আছে। র্তাহার মনটা