পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NRdV রবীন্দ্র-রচনাবলী । শোনো, আর দেরি করিয়ো না ।” অন্নদা | বিবাহ কাহার সঙ্গে হইবে যোগেন ? যোগেন্দ্র। একটিমাত্র লোক আছে। যে কাণ্ড হইয়া গেল এবং যে-সমস্ত কথাবার্তা উঠিয়াছে তাহাতে পােত্র পাওয়া অসম্ভব। কেবল বেচারা অক্ষয় রহিয়াছে, তাহাকে কিছুতেই দমাইতে পারে না। তাহাকে পিল খাইতে বল পিল খাইবে, বিবাহ করিতে বল বিবাহ করিবে । অন্নদা। পাগল হইয়াছ যোগেন ? অক্ষয়কে হেম বিবাহ করিবে ! যোগেন্দ্র। তুমি যদি গােল না কর তো আমি তাহাকে রাজি করিতে পারি। অন্নদা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “না যোগেন, না, তুমি হেমকে কিছুই বোঝা না ! তুমি তাহাকে ভয় দেখাইয়া, কষ্ট দিয়া, অস্থির করিয়া তুলিবে । এখন তাহাকে কিছুদিন সুস্থ থাকিতে দাও ; সে বেচারা অনেক কষ্ট পাইয়াছে। বিবাহের ঢের সময় আছে।” যোগেন্দ্ৰ কহিল, “আমি তাহাকে কিছুমাত্র পীড়ন করিব না, যতদূর সাবধানে ও মৃদুভাবে কাজ উদ্ধার করিতে হয় তাহার ত্রুটি হইবে না। তোমরা কি মনে কর, আমি ঝগড়া না করিয়া কথা কহিতে পারি না ?” যোগেন্দ্ৰ অধীরপ্রকৃতির লোক । সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় চুল বাধা সারিয়া হেমনলিনী বাহির হইবামাত্র যোগেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “হেম, একটা কথা আছে।” কথা আছে শুনিয়া হেমের হৃৎকম্প হইল। যোগেন্দ্রের অনুবতী হইয়া আস্তে আস্তে বসিবার ঘরে আসিয়া বসিল । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “হেম, বাবার শরীরটা কিরকম খারাপ হইয়াছে দেখিয়াছ ?” হেমনলিনীর মুখে একটা উদবেগ প্রকাশ পাইল ; সে কোনো কথা কহিল না। যোগেন্দ্র । আমি বলিতেছি, ইহার একটা প্ৰতিকার না করিলে উনি একটা শক্ত ব্যামোয় পড়িবেন। হেমনলিনী বুঝিল, পিতার এই অস্বাস্থ্যের জন্য অপরাধ তাঁহারই উপরে পড়িতেছে। সে মাথা নিচু করিয়া স্নানমুখে কাপড়ের পাড় লইয়া টানিতে লাগিল । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “যা হইয়া গেছে, সে তো হইয়াই গেছে, তাহা লইয়া যতই আক্ষেপ করিতে থাকিব, ততই আমাদের লজ্জার কথা। এখন বাবার মনকে যদি সম্পূর্ণ সুস্থ করিতে চাও তবে যত শীঘ্র পার এই সমস্ত অপ্রিয় ব্যাপারের একেবারে গোড়া মারিয়া ফেলিতে হইবে।” এই বলিয়া উত্তর প্রত্যাশা করিয়া যোগেন্দ্ৰ হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। হেম সলজমুখে কহিল, “এ-সমস্ত কথা লইয়া আমি যে কোনোদিন বাবাকে বিরক্ত করিব, এমন সম্ভাবনা নাই ।” - যোগেন্দ্র । তুমি তো করিবে না জানি, কিন্তু তাহাতে তো অন্য লোকের মুখ বন্ধ হইবে না। হেম কহিল, “তা আমি কী করিতে পারি বলে ।” যোগেন্দ্র । চারিদিকে এই যে-সব নানা কথা উঠিয়াছে তাহা বন্ধ করিবার একটিমাত্র উপায় আছে। যোগেন্দ্ৰ যে উপায় মনে মনে ঠাওরাইয়াছে হেমনলিনী তাহা বুঝিতে পারিয়া তাড়াতাড়ি কহিল, “এখনকার মতো কিছুদিন বাবাকে লইয়া পশ্চিমে বেড়াইতে গেলে ভালো হয় না ? দু-চার মাস কাটাইয়া আসিলে ততদিনে সমস্ত গোল থামিয়া যাইবে।” । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “তাহাতেও সম্পূর্ণ ফল হইবে না। তোমার মনে কোনো ক্ষোভ নাই, যতদিন বাবা এ কথা নিশ্চয় না বুঝিতে পরিবেন ততদিন তাহার মনে শেল বিধিয়া থাকিবে- ততদিন তঁহাকে কিছুতেই সুস্থ হইতে দিবে না।” দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর দুই চোখ জলে ভাসিয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি জল মুছিয়া ফেলিল ; কহিল, “আমাকে কী করিতে বল ।” যোগেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার কানে কঠোর শুনাইবে আমি জানি, কিন্তু সকল দিকের মঙ্গল যদি চাও, তোমাকে কালবিলম্ব না করিয়া বিবাহ করিতে হইবে।” হেমনলিনী স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল । যোগেন্দ্ৰ অধৈৰ্য সংবরণ করিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল,