পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

नोकाम्रुति Voy যদি তোমার বােন হইতে তবে আমার আইবড়ো নাম ঘোচাইবার জন্য পিতৃপুরুষদিগকে হতাশভাবে দিন গণনা করিতে হইত না। যেমন করিয়া হােক, একটি ভালো পত্র জোগাড় করা চাই যাহার প্রতি তাকইবামাত্র অবিলম্বে কাপড় রৌদ্রে দিবার ইচ্ছা প্রবল হইয়া না ওঠে।” যোগেন্দ্র। পাত্র তো ফরমাশ দিয়া মেলে না। অক্ষয় । তুমি একেবারে এত অল্পেই হাল ছাড়িয়া দিয়া বসো কেন ? পাত্রের সন্ধান আমি বলিতে পারি, কিন্তু তাড়াহুড়া যদি কর তবে সমস্তই মাটি হইয়া যাইবে। প্রথমেই বিবাহের কথা পাড়িয়া দুই পক্ষকে সশঙ্কিত করিয়া তুলিলে চলিবে না। আস্তে আস্তে আলাপ-পরিচয় জমিতে দাও, তাহার পরে সময় বুঝিয়া দিনস্থির করিয়ো । যোগেন্দ্র। প্ৰণালীটি অতি উত্তম, কিন্তু লোকটি কে শুনি । অক্ষয় । তুমি তাহাকে তেমন ভালো করিয়া জান না, কিন্তু দেখিয়াছ। নলিনাক্ষ ডাক্তায় । যোগেন্দ্র । নলিনাক্ষ ! অক্ষয়। চমকাও কেন ? তাহাকে লইয়া ব্ৰাহ্মসমাজে গোলমাল চলিতেছে, চলুক-না। তা বলিয়া আমন পাত্রটিকে হাতছাড়া করিবে ? যোগেন্দ্র । আমি হাত তুলিয়া লইলেই অমনি পাত্র যদি হাতছাড়া হইত, তা হইলে ভাবনা কী ছিল ? কিন্তু নলিনাক্ষ বিবাহ করিতে কি রাজি হইবেন ? অক্ষয় । আজই হইবেন এমন কথা বলিতে পারি না, কিন্তু সময়ে কী না হইতে পারে। যোগেন, আমার কথা শোনাে। কাল নলিনাক্ষের বক্তৃতার দিন আছে। সেই বক্তৃতায় হেমনলিনীকে লইয়া যাও । লোকটার বলিবার ক্ষমতা আছে । স্ত্রীলোকের চিত্ত-আকর্ষণের পক্ষে ঐ ক্ষমতাটা অকিঞ্চিৎকর নয়। হায়, অবোধ অবলারা এ কথা বোঝে না যে, বক্তা-স্বামীর চেয়ে শ্রোতা-স্বামী ঢের ভালো । যোগেন্দ্র । কিন্তু নলিনাক্ষের ইতিহাসটা কী ভালো করিয়া বলে দেখি, শোনা যাক । অক্ষয় । দেখো যোগেন, ইতিহাসে যদি কিছু খুঁত থাকে তাহা লইয়া বেশি ব্যস্ত হইয়ো না । অল্প একটুখানি খুঁতে দুর্লভ জিনিস সুলভ হয়, আমি তো সেটাকে লাভ মনে করি। অক্ষয় নলিনাক্ষের ইতিহাস যাহা বলিল, তাহা সংক্ষেপে এই— নলিনাক্ষের পিতা রাজবল্লভ ফরিদপুর-অঞ্চলের একটি ছোটােখাটাে জমিদার ছিলেন। র্তাহার বছর-ত্রিশ বয়সে তিনি ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন । কিন্তু তাহার স্ত্রী কোনোমতেই স্বামীর ধর্ম গ্ৰহণ করিলেন না এবং আচার-বিচার সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সহিত স্বামীর সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলিতে লাগিলেন— বলা বাহুল্য, ইহা রাজবল্লাভের পক্ষে সুখকর হয় নাই। র্তাহার ছেলে নলিনাক্ষ ধর্মপ্রচারের উৎসাহে ও বক্তৃতাশক্তিদ্বারা উপযুক্ত বয়সে ব্ৰাহ্মসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। তিনি সরকারি ডাক্তারের কাজে বাংলার নানা স্থানে অবস্থিতি করিয়া চরিত্রের নির্মলতা, চিকিৎসার নৈপুণ্য ও সৎকর্মের উদযোগে সর্বত্র খ্যাতি বিস্তার করিতে থাকেন। ইতিমধ্যে একটি অভাবনীয় ব্যাপার ঘটিল। বৃদ্ধ বয়সে রাজবল্লভ একটি বিধবাকে বিবাহ করিবার জন্য হঠাৎ উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন । কেহই তাহাকে নিরস্ত করিতে পারিল না। রাজবল্লভ বলিতে লাগিলেন, “আমার বর্তমান স্ত্রী আমার যথার্থ সহধর্মিণী নহে ; যাহার সঙ্গে ধর্মে মতে ব্যবহারে ও হৃদয়ে মিল হইয়াছে তাহাকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ না করিলে অন্যায় হইবে।” এই বলিয়া রাজবল্লভ সর্বসাধারণের ধিক্কারের মধ্যে সেই বিধবাকে অগত্যা হিন্দুমতানুসারে বিবাহ করিলেন । ইহার পরে নলিনাক্ষের মা গৃহত্যাগ করিয়া কাশী যাইতে প্ৰবৃত্ত হইলে নলিনাক্ষ রংপুরের ডাক্তারি ছাড়িয়া আসিয়া কহিল, “মা, আমিও তোমার সঙ্গে কাশী যাইব ।” দিয়া কহিলেন, "বাছা, আমার সঙ্গে তোদের তো কিছুই মেলে না, কেন মিছামিছ কষ্ট নলিনাক্ষ কহিল, “তোমার সঙ্গে আমার কিছুই অমিল হইবে না।” নলিনাক্ষ তাহার এই স্বামীপরিত্যক্ত অবমানিত মাতাকে সুখী করিবার জন্য দৃঢ়সংকল্প হইল।