পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Voor রবীন্দ্র-রচনাবলী অন্নদা। আপনি ডাক্তার, আপনাকে আর কী বলিব । মধ্যাহ্নভোজনের তিন-চার ঘণ্টা পরে চায়ের উপলক্ষে খানিকটা গরম জল খাওয়া হজমের পক্ষে যে নিতান্ত উপকারী । অভ্যাস না থাকে। যদি, আপনাকে নাহয় খুব পাতলা করিয়া চা তৈরি করিয়া দিই। নলিনাক্ষ চকিতের মধ্যে হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিতে পারিল যে, হেমনলিনী নলিনাক্ষের চা খাইতে সংকোচ সম্বন্ধে একটা কী আন্দাজ করিয়াছে এবং তাহাই লইয়া মনে মনে আন্দোলন করিতেছে। তৎক্ষণাৎ হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি যাহা মনে করিতেছেন তাহা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। আপনাদের এই চায়ের টেখিলকে আমি ঘূণা করিতেছি বলিয়া মনেও করিবেন না। পূর্বে আমি যথেষ্ট চা খাইয়াছি, চায়ের গন্ধে এখনো আমার মনটা উৎসুক হয়— আপনাদের চা খাইতে দেখিয়া আমি আনন্দবোধ করিতেছি। কিন্তু আপনারা বোধ হয় জানেন না, আমার মা অত্যন্ত আচারপরায়ণ— আমি ছাড়া তাহার যথার্থ আপনার কেহ নাই- সেই মার কাছে আমি সংকুচিত হইয়া যাইতে পারিব না। এইজন্য আমি চা খাই না। কিন্তু আপনারা চা খাইয়া যে সুখটুকু পাইতেছেন আমি তাহার ভাগ পাইতেছি। আপনাদের আতিথ্য হইতে আমি বঞ্চিত নাহি ।” ইতিপূর্বে নলিনাক্ষের কথাবার্তায় হেমনলিনী মনে মনে একটু যেন আঘাত পাইতেছিল। সে বুঝিতে পারিতেছিল, নলিনাক্ষ নিজেকে তাহাদের কাছে ঠিকভাবে প্রকাশ করিতেছিল না। সে কেবলই বেশি কথা কহিয়া নিজেকে ঢাকিয়া রাখিবারই চেষ্টা করিতেছিল। হেমনলিনী জানিত না, প্রথম পরিচয়ে নলিনাক্ষ একটা একান্ত সংকোচের ভাব কিছুতেই তাড়াইতে পারে না। এইজন্য নূতন লোকের কাছে অনেক স্থলেই সে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে জোর কবিয়া প্ৰগলভ হইয়া উঠে। নিজের অকৃত্রিম মনের কথা বলিতে গেলেও তাহার মধ্যে একটা বেসুর লাগাইয়া বসে। সেটা নিজের কানেও ঠেকে । সেইজন্যই আজ যোগেন্দ্র যখন অধীর হইয়া উঠিয়া পড়িল তখন নলিনাক্ষ মনের মধ্যে একটা ধিক্কার অনুভব করিয়া তাহার সঙ্গে পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু নলিনাক্ষ যখন মার কথা বলিল তখন হেমনলিনী শ্রদ্ধার চক্ষে তাহার মুখের দিকে না চাহিয়া থাকিতে পারিল না, এবং মাতার উল্লেখমাত্রে সেই মুহুর্তেই নলিনাক্ষের মুখে যে একটি সরস ভক্তির গাম্ভীৰ্য প্রকাশ পাইল তাহা দেখিয়া হেমনলিনীর মন আদ্ৰ হইয়া গেল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল নলিনাক্ষের মাতার সম্বন্ধে তাহার সঙ্গে আলোচনা করে, কিন্তু সংকোচে তাহা পারিল না । অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বিলক্ষণ। এ কথা পূর্বে জানিলে আমি কখনােই আপনাকে চা খাইতে অনুরোধ করিতাম না। মাপ করিবেন।” নলিনাক্ষ একটু হাসিয়া কহিল, “চা লইতে পারিলাম না বলিয়া আপনাদের স্নেহের অনুরোধ হইতে কেন বঞ্চিত হইব ?” নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে হেমনলিনী তাহার পিতাকে লইয়া দোতলার ঘরে গিয়া বসিল এবং বাংলা মাসিক পত্রিকা হইতে প্ৰবন্ধ বাছিয়া তাহাকে পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। শুনিতে শুনিতে অন্নদাবাবু অনতিবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িলেন । কিছুদিন হইতে অন্নদাবাবুর শরীরে এইরূপ অবসাদের লক্ষণ নিয়মিতভাবে প্ৰকাশ পাইতেছে। 8 ○ কয়েক দিনের মধ্যেই নলিনাক্ষের সহিত অন্নদাবাবুদের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হইয়া আসিল। প্রথমে হেমনলিনী মনে করিয়াছিল, নলিনাক্ষের মতো লোকের কাছে কেবল বড়ো বড়ো আধ্যাত্মিক বিষয়েই বুঝি উপদেশ পাওয়া যাইবে ; এমন মানুষের সঙ্গে যে সাধারণ বিষয়ে সহজ লোকের মতো আলাপ চলিতে পারে তাহা মনেও করিতে পারে নাই। অথচ সমস্ত হাস্যালাপের মধ্যে নলিনাক্ষের একটা কেমন দূরত্বও ছিল। একদিন অন্নদাবাবু ও হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের কথাবার্তা চলিতেছিল, এমন সময়ে যোগেন্দ্র