পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ওভারকোটের বৃহৎ পকেট হইতে বাহির করিয়া লইল । বাংলার সম্মুখে আসিয়া রমেশ দেখিল, বিষণা-বেহাৱা বারান্দায় শুইয়া অকাতরে নিদ্ৰা দিতেছেঘরের দ্বারগুলি বন্ধ। বিমর্ষমুখে রমেশ একটু থমকিয়া দাড়াইল। একটু উচ্চস্বরে ডাকিল, “বিষণ । ভাবিল, এই ডাকে ঘরের ভিতরকার নিদ্ৰাও ভাঙিবে। কিন্তু এমন করিয়া নিদ্রা ভাঙাইবার যে অপেক্ষা আছে, ইহাই তাহার মনে বাজিল ; রমেশ তাে অর্ধেক রাত্রি ঘুমাইতে পারে নাই। দুই-তিন ডাকেও বিষণ উঠিল না ; শেষকালে ঠেলিয়া তাহাকে উঠাইতে হইল। বিষাণ উঠিয় বসিয়া ক্ষণকাল হতবুদ্ধির মতো তাকাইয়া রহিল। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “বহুজি ঘরে আছেন ?" বিষন প্রথমটা রমেশের কথা যেন বুঝিতেই পারিল না ; তাহার পরে হঠাৎ চমকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “হা, তিনি ঘরেই আছেন ।” এই বলিয়া সে পুনর্বার শুইয়া পড়িয়া নিদ্ৰা দিবার উপক্ৰম করিল। রমেশ দ্বার ঠেলিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে গিয়া ঘরে ঘরে ঘুরিয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই। তথাপি একবার উচ্চৈঃস্বরে ডাকিল, “কমলা !" কোথাও কোনো সাড়া পাইল না। বাহিরের বাগানে নিমগাছতলা পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিল ; রান্নাঘরে, চাকরদের ঘরে, আস্তাবল-ঘরে সন্ধান করিয়া আসিল ; কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইল না। তখন রৌদ্র উঠিয়া পড়িয়াছে— কাকগুলা ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বাংলার ইদারা হইতে জল লইবার জন্য কলস মাথায় পাড়ার মেয়ে দুই-এক জন দেখা দিতেছে। পথের ওপারে কুটিরপ্রাঙ্গণে কোনো পল্লীনারী বিচিত্র উচ্চ সুরে গান গাহিতে গাহিতে জাতীয় গম ভাঙিতে আরম্ভ করিয়াছে । রমেশ বাংলাঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, বিষন পুনরায় গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন । তখন সে নত হইয়া দুই হাতে খুব করিয়া বিষণকে ঝাকানি দিতে লাগিল ; দেখিল, তাহার নিশ্বাসে তাড়ির প্রবল গন্ধ ছুটিতেছে। বঁকানির বিষম বেগে বিষণা অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া দাড়াইল । রমেশ পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিল, “বহুজি কোথায় ?” বিষণ কহিল, “বহুজি তো ঘরেই আছেন।” রমেশ ! কই, ঘরে কোথায় ? বিষণ। কাল তো এখানেই আসিয়াছেন । রমেশ । তাহার পরে কোথায় গেছেন ? বিষণা হা করিয়া রমেশের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। এমন সময়ে খুব চওড়া পাড়ের এক বাহারে ধুতি পরিয়া চাদর উড়াইয়া রক্তবর্ণচক্ষু উমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। রমেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশা, তোর মা কোথায় ?” উমেশ কহিল, “মা তো কাল হইতে এখানেই আছেন।” রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কোথায় ছিলি ?” উমেশ কহিল, “আমাকে মা কাল বিকালে সিধুবাবুদের বাড়ি যাত্রা শুনিতে পাঠাইয়াছিলেন ' গাড়োয়ান আসিয়া কহিল, “বাবু, আমার ভাড়া।” রমেশ তাড়াতাড়ি সেই গাড়িতে চড়িয়া একেবারে খুড়ার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া দেখিল, বাড়িসুদ্ধ সকলেই যেন চঞ্চল। রমেশের মনে হইল, কমলার বুঝি কোনো অসুখ করিয়াছে। কিন্তু তাহা নহে। কাল সন্ধ্যার কিছু পরেই উমা হঠাৎ অত্যন্ত চীৎকার করিয়া কাদিতে আরম্ভ করিল এবং তাহার মুখ নীল ও হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া পড়ায় সকলেই অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেল। সুচিকিৎসা গািয়কাল বাড়িসুদ্ধ সকল ব্যতিবস্তু ইয়াছিল। সমস্ত রাত কহ মইতোপ রমেশ মনে করিল, উমির অসুখ হওয়াতে নিশ্চয়ই কাল কমলাকে এখানে আনানো হইয়াছিল। বিপিনকে কহিল, “কমলা তা হইলে উমিকে লইয়া খুবই উদবিগ্ন হইয়া আছে ?” ।