পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9Yხr রবীন্দ্র-রচনাবলী রমেশ আর গােপন করিবার কারণ দেখিল না ; সে কহিল, “প্র্যাকটিস করিতে গাজিপুর গিয়াছিলাম।” চন্দ্র । এখন তবে কি সেইখানেই থাকা হইবে ? রমেশ । না, সেখানে আমার থাকা হইল না ; এখন কোথায় যাইব ঠিক করি নাই। রমেশ চলিয়া যাইবার অনতিকাল পরেই অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত হইল। যোগেন্দ্ৰ চলিয়া যাইবা সময়, মাঝে মাঝে তাহাদের বাড়ির তত্ত্বাবধানের জন্য অক্ষয়ের উপর ভার দিয়া গিয়াছিল। অক্ষয় ভার গ্রহণ করে তাহা রক্ষা করিতে কখনো শৈথিল করে না ; তাই সে হঠাৎ যখন-তখন আসিয়া দেখিয়া যায়, বাড়ির বেহারা দুজনের মধ্যে একজনও হাজির থাকিয়া খবরদারি করিতেছে কি না। চন্দ্রমোহন তাহাকে কহিল, “রমেশবাবু এই খানিকক্ষণ হইল এখান হইতে চলিয়া গেলেন।” অক্ষয় । বলেন কী ! কী করিতে আসিয়াছিলেন ? চন্দ্র । তাহা তো জানি না। আমার কাছে অন্নদাবাবুদের সমস্ত খবর জানিয়া লইলেন । এমন রোগ হইয়া গেছেন, হঠাৎ তাহাকে চেনাই কঠিন ; যদি বেহারাকে না ডাকিতেন। আমি চিনিতে পারিতাম না। অক্ষয় । এখন কোথায় থাকেন, খবর পাইলেন ? চন্দ্র। এতদিন গাজিপুরে ছিলেন ; এখন সেখান হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন, কোথায় থাকিবেন ঠিক করিয়া বলিতে পারিলেন না । অক্ষয় বলিল, “ও ” বলিয়া আপন কর্মে মন দিল । রমেশ বাসায় ফিরিয়া আসিয়া ভাবিতে লাগিল, “অদৃষ্ট এ কী বিষম কৌতুকে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে। এক দিকে আমার সঙ্গে কমলার ও অন্য দিকে নলিনাক্ষের সঙ্গে হেমনলিনীর এই মিলন, এ যে একেবারে উপন্যাসের মতো— সেও কুলিখিত উপন্যাস। এমনতরো ঠিক উলটাপালটা মিল করিয়া দেওয়া অদৃষ্ট্রেরই মতো বেপরোয়া রচয়িতার পক্ষেই সম্ভব— সংসারে সে এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় যাহা ভীরু লেখক কাল্পনিক উপাখ্যানে লিখিতে সাহস করে না ।” কিন্তু রমেশ ভাবিল, এবার সে যখন তাহার জীবনের সমস্যাজাল হইতে মুক্ত হইয়াছে, তখন খুব সম্ভব, অদৃষ্ট এই জটিল উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে রমেশের পক্ষে নিদারুণ উপসংহার লিখিবে না | যোগেন্দ্ৰ বিশাইপুর জমিদারবাড়ির নিকটবর্তী একটি একতলা বাড়িতে বাসা পাইয়াছিল ; সেখানে রবিবার সকালে খবরের কাগজ পড়িতেছিল এমন সময় বাজারের একটি লোক তাহার হাতে একখানি চিঠি দিল । খামের উপরকার অক্ষর দেখিয়াই সে আশ্চর্য হইয়া গেল। খুলিয়া দেখিল রমেশ লিখিয়াছে— সে বিশাইপুরে একটি দোকানে অপেক্ষা করিতেছে, বিশেষ কয়েকটি কথা বলিবার আছে । যোগেন্দ্ৰ একেবারে চৌকি ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিল । রমেশকে যদিও সে একদিন অপমান করিতে বাধ্য হইয়াছিল। তবু সেই বাল্যবন্ধুকে এই দূরদেশে এতদিন আদর্শনের পরে ফিরাইয়া দিতে পারিল না। এমন-কি, তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দই হইল, কৌতুহলও কম হইল না। বিশেষত হেমনলিনী যখন কাছে নাই, তখন রমেশের দ্বারা কোনো অনিষ্টের আশঙ্কা করা যায় না । পত্ৰবাহকটিকে সঙ্গে করিয়া যোগেন্দ্র নিজেই রমেশের সন্ধানে চলিল। দেখিল, সে একটি মুর্দিষ্ট দোকানে একটা শূন্য কেরোসিনের বাক্স খাড়া করিয়া তাহার উপরে চুপ করিয়া বসিয়া আছে ; মুদ ব্ৰাহ্মণের ছকায় তাহাকে তামাক দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু চশমা-পরা বাবুটি তামাক খায় না শুনিয়া মুদি তাহাকে শহরজাত কোনাে অদ্ভুতশ্রেণীয় পদার্থের মধ্যে গণ্য করিয়াছিল। সেই অবধি পরস্পর্ণে মধ্যে কোনোপ্রকার আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টা হয় নাই । যোগেন্দ্ৰ সবেগে আসিয়া একেবারে রমেশের গাত ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল ; কহিল,”তোমার্চ সঙ্গে পারা গেল না । তুমি আপনার দ্বিধা লইয়াহ গেলে । কোথায় একেবারে সোজা আমার বাসী; আসিয়া হাজির হইবে, না, পথের মধ্যে মুদির দোকানে গুড়ের বাতাসা ও মুড়ির চাকতির মাঝখা" অটল হইয়া বসিয়া আছ!”