পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৬ - রবীন্দ্র-রচনাবলী ভুলিতে পারে নাই। অন্য দিন আহারের পরেই অন্নদাবাবু শুইতে যাইতেন, আজ বারান্দায় ক্যামবিসের কেদারার উপরে বসিয়া বাড়ির বাগানের সম্মুখবর্তী ক্যান্টনমেন্টের নির্জন রাস্তার দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিলেন। হেমনলিনী আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “বাবা, এখানে বড়ো ঠাণ্ডা, শুইতে চলো।” অন্নদা কহিলেন, “তুমি শুইতে যাও, আমি একটু পরেই যাইতেছি।” • হেমনলিনী চুপ করিয়া তঁহার পাশে দাড়াইয়া রহিল। আবার খানিক বাদেই কহিল, “বাবা, তোমার ঠাণ্ডা লাগিতেছে, নাহয় বসিবার ঘরেই চলো।” । তখন অন্নদাবাবু চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া, কিছু না বলিয়া শুইতে গেলেন । পাছে তাহার কর্তব্যের ক্ষতি হয় বলিয়া হেমনলিনী রমেশের কথা মনে মনে আন্দোলন করিয়া নিজেকে পীড়িত হইতে দেয় না। এজন্য এ পর্যন্ত সে নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করিয়া আসিতেছে। কিন্তু বাহির হইতে যখন টান পড়ে তখন ক্ষতস্থানের সমস্ত বেদনা জাগিয়া উঠে । হেমনলিনীর ভবিষ্যৎ জীবনটা যে কী ভাবে চলিবে তাহা এ পর্যন্ত সে পরিষ্কার কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, এই কারণেই একটা সুদৃঢ় কোনাে অবলম্বন খুঁজিয়া অবশেষে নলিনাক্ষকে গুরু মানিয়া তাহার উপদেশ-অনুসারে চলিতে প্ৰস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু যখনই বিবাহের প্রস্তাবে তাহাকে তাহার হৃদয়ের গভীরতম দেশের আশ্রয়সূত্র হইতে টানিয়া আনিতে চাহে তখনই সে বুঝিতে পারে, সে বন্ধন কী কঠিন ! তাহাকে কেহ ছিন্ন করিতে আসিলেই হেমনলিনীর সমস্ত মন ব্যাকুল হইয়া সেই বন্ধনকে দ্বিগুণবলে আঁকড়িয়া ধরিতে চেষ্টা করে । (O এ দিকে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া কহিলেন, “আমি তোমার পাত্রী ঠিক করিয়াছি।” নলিনাক্ষ একটু হাসিয়া কহিল, “একেবারে ঠিক করিয়া ফেলিয়াছ ?” ক্ষেমংকরী । তা নয় তো কী ? আমি কি চিরকাল বঁাচিয়া থাকিব ? তা শোনো, আমি হেমনলিনীকেই পছন্দ করিয়াছি- অমন মেয়ে আর পাইব না। রঙটা তেমন ফর্সা নয় বটে, কিন্তুনলিনাক্ষ । দোহাই মা, আমি রঙ ফর্সার কথা ভাবিতেছি না । কিন্তু হেমনলিনীর সঙ্গে কেমন করিয়া হইবে ? সে কি কখনো হয় ? ক্ষেমংকরী । ও আবার কী কথা । না হইবার তো কোনো কারণ দেখি না । নলিনাক্ষের পক্ষে ইহার জবাব দেওয়া বড়ো মুশকিল। কিন্তু হেমনলিনী- এতদিন যাহাকে কাছে লইয়া অসংকোচে গুরুর মতো উপদেশ দিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ তাহার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবে নলিনাক্ষকে যেন লাজ আঘাত করিল। নলিনাক্ষকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এবারে আমি তোমার কোনো আপত্তি শুনিব না। আমার জন্য তুমি যে এই বয়সে সমস্ত ছাড়িয়া দিয়া কাশীবাসী হইয়া তপস্যা করিতে থাকিবে, সে আমি আর কিছুতেই সহ্য করিব না। এইবারে যেদিন শুভদিন আসিবে সেদিন ফাক যাইবে না, এ আমি বলিয়া রাখিতেছি।” নলিনাক্ষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, “তবে একটা কথা তোমাকে বলি মা । কিন্তু আগে হইতে বলিয়া রাখিতেছি, তুমি অস্থির হইয়া পড়িয়ে না । যে ঘটনার কথা বলিতেছি সে আজ নয়-দশ মাস হইয়া গেল, এখন তাহা লইয়া উতলা হইবার কোনো প্রয়োজন নাই। কিন্তু তোমার যেরকম স্বভাব মা, একটা অমঙ্গল কাটিয়া গেলেও তাহার ভয় তোমাকে কিছুতেই ছাড়িতে চায় না। এইজন্যই কতদিন তোমাকে বলিব-বলিব করিয়াও বলিতে পারি নাই। আমার গ্রহশান্তির জন্য যত খুশি স্বস্ত্যয়ন করাইতে চাও করাইয়ো, কিন্তু অনাবশ্যক মনকে পীড়িত করিয়ো না ।” ক্ষেমংকরী উদবিগ্ন হইয়া কহিলেন, “কী জানি বাছা, কী বলিবে, কিন্তু তোমার ভূমিকা শুনিয়া আমার মন আরো অস্থির হয়। যতদিন পৃথিবীতে আছি নিজেকে অত করিয়া ঢাকিয়া রাখা চলে না।