পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি \0&& কোনাে কুসংবাদ থাকে। আমিও তো তোমাদের বলিয়া রাখিয়াছি, আমাকে কোনো খবর দিবার উপরে আর কেন । (ζ Σ কমলা যখন গঙ্গাতীরে গিয়া পৌছিল, শীতের সূর্য তখন রশ্মিচ্ছটাহীন স্নান পশ্চিমাকাশের প্রান্তে নামিয়াছেন । কমলা আসন্ন অন্ধকারের সম্মুখীন সেই অস্তগামী সূর্যকে প্ৰণাম করিল। তাহার পরে মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া নদীর মধ্যে কিছুদূর নামিল এবং জোড়করপুটে গঙ্গায় জলগণ্ডুষ অঞ্জলি দান করিয়া ফুল ভাসাইয়া দিল । তার পর সমস্ত গুরুজনদের উদ্দেশ করিয়া প্ৰণাম করিল। প্ৰণাম করিয়া মাথা তুলিতেই আর-একটি প্ৰণম্য ব্যক্তির কথা সে মনে করিল। কোনোদিন মুখ তুলিয়া তাহার মুখের দিকে সে চাহে নাই ; যখন একদিন রাত্রে সে তাহার পাশে বসিয়াছিল তখন তাহার পায়ের দিকেও তাহার চোখ পড়ে নাই, বাসরঘরে অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনি যে দু-চারিটা কথা কহিয়াছিলেন তাহাও সে যেন ঘোমটার মধ্য দিয়া, লজ্জার মধ্য দিয়া, তেমন সুস্পষ্ট করিয়া শুনিতে পায় নাই । তাহার সেই কণ্ঠস্বর স্মরণে আনিবার জন্য আজ এই জলের ধারে দাড়াইয়া সে একান্তমনে চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনোমতেই মনে আসিল না । অনেক রাত্রে তাহার বিবাহের লগ্ন ছিল ; নিতান্ত শ্ৰান্তশরীরে সে যে কখন কোথায় ঘুমাইয়া পডিয়ছিল তাহাও মনে নাই ; সকালে জাগিয়া দেখিল, তাহাদের প্রতিবেশীর বাড়ির একটি বধু তাহাকে ঠেলিয়া জাগাইয়া খিলখিল করিয়া হাসিতেছে- বিছানায় আর কেহই নাই। জীবনের এই শেষ মুহুর্তে জীবনেশ্বরকে স্মরণ করিবার সম্বল তাহার কিছুমাত্র নাই। সে দিকে একেবারে অন্ধকার— কোনো মূর্তি নাই, কোনো বাক্য নাই, কোনো চিহ্ন নাই। যে লাল চেলিটির সঙ্গে তাহার চাদরের গ্রন্থি বাধা হইয়াছিল তারিণীচরণের প্রদত্ত সেই নিতান্ত অল্পদামের চেলির মূল্য তো কমলা জানিত না ; সে চেলিখনিও সে যত্ন করিয়া রাখে নাই । রমেশ হেমনলিনীকে যে চিঠি লিখিয়াছিল। সেখানি কমলার আঁচলের প্রান্তে বাধা ছিল ; সেই চিঠি খুলিয়া বালুতটে বসিয়া তাহার একটি অংশ গোধূলির আলোকে পড়িতে লাগিল। সেই অংশে তাহার স্বামীর পরিচয় ছিল- বেশি কথা নয়, কেবল তাহার নাম নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়, আর তিনি যে রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন ও এখন সেখানে তাহার খোজ পাওয়া যায় না, এইটুকুমাত্র । চিঠির বাকি অংশ সে অনেক সন্ধান করিয়াও পায় নাই। 'নলিনাক্ষ' এই নামটি তাহার মনের মধ্যে সুধাবর্ষণ । করিতে লাগিল ; এই নামটি তাহার সমস্ত বুকের ভিতরটা যেন ভরিয়া তুলিল ; এই নামটি যেন এক বস্তুহীন দেহ লইয়া তাহাকে আবিষ্ট করিয়া ধরিল ; তাহার চোখ দিয়া অবিশ্রাম ধারা বাহিয়া জল পড়িয়া তাহার হৃদয়কে স্নিগ্ধ করিয়া দিল- মনে হইল, তাহার অসহ্য দুঃখদাহ যেন জুড়াইয়া গেল। কমলার অন্তঃকরণ বলিতে লাগিল, “এ তো শূন্যতা নয়, এ তো অন্ধকার নয়- আমি দেখিতেছি, সে যে আছে, সে আমারই আছে।” তখন কমলা প্ৰাণপণ বলে বলিয়া উঠিল, “আমি যদি সতী হই, তবে এই জীবনেই আমি তাহার পায়ের ধূলা লইব, বিধাতা আমাকে কখনােই বাধা দিতে পরিবেন না। আমি যখন আছি তখন তিনি কখনোই যান নাই, তাহারই সেবা করিবার জন্য ভগবান আমাকে বঁাচাইয়া রাখিয়াছেন।” এই বলিয়া সে তাহার রুমালে বাধা চাবির গোছা সেইখানেই ফেলিল এবং হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, রমেশের দেওয়া একটা ব্রোেচ তাহার কাপড়ে বেঁধানো আছে। সেটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া জলের মধ্যে ফেলিয়া দিল। তাহার পরে পশ্চিমে মুখ করিয়া সে চলিতে আরম্ভ করিল— কোথায় যাইবে, কী করিবে, তাহা তাহার মনে স্পষ্ট ছিল না ; কেবল সে জানিয়াছিল, তাহাকে চলিতেই হহবে, এখানে তাহার এক মুহুর্ত দাড়াইবার স্থান নাই। শীতের দিনান্তের আলোকটুকু নিঃশেষ হইয়া যাইতে বিলম্ব হইল না। অন্ধকারের মধ্যে সাদা