পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি w9x9ዓ. সেইখনেই তাঁহাকে চা খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিতেছে। গতরাত্রের কষ্ট্রে অন্নদাবাবুর মুখ বিবর্ণ ও শীর্ণ হইয়া গেছে, তাহার চোখের নীচে কালি পড়িয়ছে, মনে হইতেছে যেন এক রাত্রির মধ্যেই তাহার বয়স অনেক বাড়িয়া গেছে । যখনই অন্নদাবাবুর এই ক্লিষ্ট মুখের প্রতি হেমনলিনীর চােখ পড়তেছে তখনই তাহার বুকের মধ্যে যেন ছুরি বিধিতেছে। নলিনাক্ষের সহিত বিবাহে হেমনলিনীর অসম্মতিতেই যে বৃদ্ধ ব্যথিত হইয়াছেন, । আর র্তাহার সেই মনোবেদনাই যে তাহার পীড়ার অব্যবহিত কারণ, ইহা হেমনলিনীর পক্ষে একান্ত পরিতাপের বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। সে যে কী করবে, কী করিলে বৃদ্ধ পিতাকে সাত্মনা দিতে পারিবে, তাহা বার বার করিয়া ভাবিয়া কোনোমতেই স্থির করিতে পারিতেছিল না । এমন সময় হঠাৎ খুড়াকে লইয়া অক্ষয় সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। হেমনলিনী তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিতেই অক্ষয় কহিল, “আপনি যাইবেন না, ইনি গাজিপুরের চক্রবর্তমহাশয়, ইহাকে পশ্চিম-অঞ্চলের সকলেই জানে- আপনাদের সঙ্গে ইহার বিশেষ কথা আছে।” সেই জায়গাটাতে বাধানো চাতালের মতো ছিল, সেইখানে খুড়া আর অক্ষয় বসিলেন। খুড়া কহিলেন, “শুনিলাম, রমেশবাবুর সঙ্গে আপনাদের বিশেষ বন্ধুত্ব আছে, আমি তাই জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি তাহার স্ত্রীর খবর কি আপনারা কিছু পাইয়াছেন ?” অন্নদাবাবু ক্ষণকাল অবাক হইয়া রহিলেন, তাহার পরে কহিলেন, “রমেশবাবুর স্ত্রী !” হেমনলিনী চক্ষু নত করিয়া রহিল । চক্রবর্তী কহিলেন, “মা, তোমরা আমাকে বোধ করি নিতান্ত সেকেলে অসভ্য মনে করিতেছ। একটু ধৈর্থ ধরিয়া সমস্ত কথা শুনিলেই বুঝিতে পরিবে, আমি খামকা গায়ে পড়িয়া পরের কথা লইয়া তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করিতে আসি নাই। রমেশবাবু পূজার সময় তাহার স্ত্রীকে লইয়া স্টীমারে করিয়া যখন পশ্চিমে যাত্ৰা করিয়াছিলেন, সেই সময়ে সেই স্টীমারেই তঁহাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয় । আপনারা তো জানেন, কমলাকে যে একবার দেখিয়াছে, সে তাহাকে কখনো পর বলিয়া মনে করিতে পারে না। আমার এই বুড়াবয়সে অনেক শোকতাপ পাইয়া হৃদয় কঠিন হইয়া গেছে, কিন্তু আমার সেই মা-লক্ষ্মীকে তো কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছি না। রমেশবাবু কোথায় যাইবেন, কিছুই ঠিক করেন নাই- কিন্তু এই বুড়াকে দুই দিন দেখিয়াই মা কমলার এমনি স্নেহ জন্মিয়া গিয়াছিল যে, তিনি রমেশবাবুকে গাজিপুরে আমার বাড়িতেই উঠিতে রাজি করেন। সেখানে কমলা, আমার মেজো মেয়ে শৈলর কাছে আপনি বােনের চেয়ে যত্নে ছিল। কিন্তু কী যে হইল, কিছুই বলিতে পারি না- মা যে কেন আমাদের সকলকে এমন করিয়া কাদাইয়া হঠাৎ চলিয়া গেলেন তাহা আজ পর্যন্ত ভাবিয়া পাইলাম না। সেই অবধি শৈলর চোখের জল আর কিছুতেই শুকাইতেছে না।” | বলিতে বলিতে চক্রবর্তীর দুই চােখ বাহিয়া জল পড়িতে লাগিল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন ; কহিলেন, “র্তাহার কী হইল, তিনি কোথায় গেলেন ?” খুড়া কহিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনি তো সকল কথা শুনিয়াছেন, আপনিই বলুন। বলিতে গেলে আমার বুক ফাটিয়া যায়।” অক্ষয় আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপারটি বিস্তারিত করিয়া বৰ্ণনা করিল। নিজে কোনোপ্রকার টীকা করিল না, কিন্তু তাহার বর্ণনায় রমেশের চরিত্রটি রমণীয় হইয়া ফুটিয়া উঠিল না । , অন্নদাবাবু বার বার করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমরা তো এ-সমস্ত কথা কিছুই শুনি নাই। রমেশ যেদিন হইতে কলিকাতার বাহির হইয়াছেন, তাহার একখানি পত্রও পাই নাই।” r অক্ষয় সেইসঙ্গে যোগ দিল, “এমন-কি, তিনি যে কমলাকে বিবাহ করিয়াছেন এ কথাও আমরা নিশ্চয় জানিতাম না। আচ্ছা চক্রবর্তমহাশয়, আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, কমলা রমেশের স্ত্রী তাে বাটন ? ভয়ী বা আর কোনো আত্মীয়া তো নহেন ?” চক্রবর্তী কহিলেন, “আপনি বলেন কী অক্ষয়বাবু ? স্ত্রী নহেন তো কী ! এমন সতীলক্ষ্মী স্ত্রী কয়জনের ভাগ্যে জোটে ?”