পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি VO8. শৈল কহিল, “না ভাই, উমির শরীর তেমন ভালো নাই।” খুড়া যে পথ দিয়া স্নানের ঘাটে গেলেন স্নানান্তে সে পথ দিয়া না ফিরিয়া অন্য এক রাস্তায় চলিলেন। কিছু দূর গিয়াই দেখিলেন, একটি প্রবীণা স্নান সারিয়া পট্টবস্ত্র পরিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া ধীরে ধীরে আসিতেছেন । কমলাকে সম্মুখে আনিয়া খুড়া কহিলেন, “মা, ইহাকে প্ৰণাম করো, ইনি ডাক্তারবাবুর মাতা।” কমলা শুনিয়া চকিত হইয়া উঠিয়া, তৎক্ষণাৎ ক্ষেমঙ্করীকে প্ৰণাম করিয়া ঠাঁহার পায়ের ধুলা লইল । ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তুমি কে গা ! দেখি দেখি, কী রূপ! যেন লক্ষ্মীটির প্রতিমা !” বলিয়া কমলার ঘোমটা সরাইয়া তাহার নতনেত্ৰ মুখখানি ভালো করিয়া দেখিলেন। কহিলেন, “তোমার নাম কী বাছা ?” কমলা উত্তর করিবার পূর্বেই খুড়া কহিলেন, “ইহার নাম হরিদাসী। ইনি আমার দূরসম্পর্কের ভ্রাতুষ্পপুত্রী । ইহার মা-বাপ কেহ নাই, আমার উপরেই নির্ভর।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আসুন-না চক্রবর্তমশায়, আমার বাড়িতেই আসুন।” বাড়িতে লইয়া গিয়া ক্ষেমংকরী একবার নলিনাক্ষকে ডাকিলেন । নলিনাক্ষ তখন বাহির হইয়া গেছেন । খুড়া আসন গ্ৰহণ করিলেন, কমলা মেজের উপরে বসিল । খুড়া কহিলেন, “দেখুন, আমার এই ভাইঝির ভাগ্য বড়ো মন্দ । বিবাহের পরদিনই ইহার স্বামী সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া গেছেন, ইহার সঙ্গে আর দেখা-সাক্ষাৎ নাই। হরিদাসীর ইচ্ছা ধৰ্মকৰ্ম লইয়া তীর্থবাস করে- ধর্ম ছাড়া উহার সাস্তুনার সামগ্ৰী আর তো কিছুই নাই। এখানে আমার বাড়ি নয়, আমার চাকরি আছে- উপাৰ্জন করিয়া আমাকে সংসার চালাইতে হয় । আমি যে এখানে আসিয়া ইহাকে লইয়া থাকিব, আমার এমন সুবিধা নাই। তাই আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। এটিকে আপনার মেয়ের মতো যদি কাছে রাখেন। তবে আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হই। যখনই অসুবিধা বােধ করিবেন গাজিপুরে আমার কাছে পাঠাইয়া দিবেন। কিন্তু আমি বলিতেছি দুদিন ইহাকে কাছে রাখিলেই মেয়েটি কী রত্ন তাহা বুঝিতে পরিবেন, তখন মুহূর্তের জন্য ছাড়িতে চাহিবেন না।” ক্ষেমংকরী খুশি হইয়া কহিলেন, “আহা, এ তো ভালো কথা। এমন মেয়েটিকে আপনি যে আমার কাছে রাখিয়া যাইতেছেন, এ তো আমার মস্ত লাভ । আমি কতদিন রাস্ত হইতে পরের মেয়েকে বাড়িতে আনিয়া খাওয়াইয়া পরাইয়া আনন্দ করি, কিন্তু তাহদের তো রাখিতে পারি না । তা, হরিদাসী আমারই হইল, আপনি ইহার জন্য কিছুমাত্ৰ ভাবিবেন না। আমার ছেলের কথা অবশ্য আপনারা পাঁচজনের কাছে শুনিয়া থাকিবেন- নলিনাক্ষ- সে বড়ো ভালো ছেলে । সে ছাড়া বাড়িতে আর কেহ নাই ।” খুড়া কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবুর নাম সকলেই জানে। তিনি এখানে আপনার কাছে থাকেন জানিয়া আমি আরো নিশ্চিন্ত । আমি শুনিয়াছি, বিবাহের পর দুর্ঘটনায় তাহার স্ত্রী জলে ডুবিয়া মারা যাওয়াতে তিনি সেই অবধি একরকম ব্ৰহ্মচারীর মতোই আছেন।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে যাহা হইয়াছে হইয়াছে, ও কথা আর তুলিবেন না- মনে করিলেও আমার গায়ে কাটা দিয়া ওঠে ।” খুড়া কহিলেন, “যদি অনুমতি করেন তবে মেয়েটিকে আপনার কাছে রাখিয়া এখন বিদায় হই । ভুঞ্জ আসিয়া দেখিয়া যাই। ইহার একটি বড়ো বোন আছে, সেও আপনাকে প্ৰণাম করিতে খুড়া চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী কমলাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “এসো তো মা, দেখি । তোমার বয়স তো বেশি নয় । আহা, তোমাকে ফেলিয়া যাইতে পারে, জগতে এমন পাষাণও আছে ! আমি আশীর্বাদ করিতেছি, সে আবার ফিরিয়া আসিবে। বিধাতা এত রূপ। কখনো বৃথা নষ্ট করিবার O||SV)