পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 by রবীন্দ্র-রচনাবলী জন্য গড়েন নাই ।” বলিয়া কমলার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির দ্বারা চুম্বন গ্ৰহণ করিলেন। প্রকৃছিলেন। এখােন তােমাৰ সমবাসী সঙ্গী বহু বই একলা আমার কাছে থাকতে ( Qof কমলা তাহার দুই বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করিয়া কহিল, “পারিব মা !” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তোমার দিন কাটিবে কী করিয়া আমি তাই ভাবিতেছি।” কমলা কহিল, “আমি তোমার কাজ করিব।” ক্ষেমংকরী । পোড়াকপাল ! আমার আবার কাজ ! সংসারে ঐ তো আমার একটিমাত্র ছেলে, সেও সন্ন্যাসীর মতো থাকে— কখনো যদি বলিত ‘মা, এইটে আমার দরকার আছে, আমি এইটে খেতে চাই, আমি এইটে ভালোবাসি, তবে আমি কত খুশি হইতাম- তাও কখনো বলে না। রোজগার ঢের করে, হাতে কিছুই রাখে না ; কত সৎকাজে যে কত দিকে খরচ করে তাহা কাহাকে জানিতেও দেয় না। দেখো বাছা, আমার কাছে যখন তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা থাকিতে হইবে তখন এ কথা আগে হইতেই বলিয়া রাখিতেছি, আমার মুখে আমার ছেলের গুণগান বার বার শুনিয়া তোমার বিরক্ত ধরিবে, কিন্তু ঐটে তোমাকে সহ্য করিয়া যাইতে হইবে । কমলা পুলকিতচিত্তে চক্ষু নত করিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি তোমাকে কী কাজ দিব, তাই ভাবিতেছি । সেলাই করিতে জান ?” কমলা কহিল, “ভালো জানি না মা !” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমাকে সেলাই শিখাইয়া দিব ।” ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “পড়িতে জান তো ?” কমলা কহিল, “হা, জানি ।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে হইল ভালো। চােখে তো আর চশমা নহিলে দেখিতে পাই না, তুমি আমাকে পড়িয়া শোনাইতে পরিবে ।” কমলা কহিল, “আমি রাধাবাড়া ঘরকন্নার কাজ সমস্ত শিখিয়াছি।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “অমন অন্নপূর্ণর মতো চেহারা, তুমি যদি রাধাবাড়ার কাজ না জানিবে তো কে জানিবে। আজ পর্যন্ত নলিনকে আমি নিজে রাধিয়া খাওয়াইয়াছি- আমার অসুখ হইলে বরঞ্চ স্বপাক রাধিয়া খায়, তবু আর কাহারও হাতে খায় না। এবার হইতে তোমার কল্যাণে তাহার স্বপাক খাওয়া আমি ঘোচাইব । আর, অক্ষম হইয়া পড়িলে আমাকেও যদি চারটিখনি হবিষ্যান্ন রাধিয়া খাওয়াও তো আমার তাহাতে অনভিরুচি হইবে না। চলো মা, তোমাকে আমার ভাড়ার-ঘর রান্নাঘর সমস্ত দেখাইয়া আনি ৷” এই বলিয়া ক্ষেমংকরী তাহার ক্ষুদ্র ঘরকন্নার সমস্ত নেপথ্যগৃহ কমলাকে দেখাইলেন । কমলা ইতিমধ্যে একটা অবকাশ বুঝিয়া আস্তে আস্তে আপনার দরখাস্ত জারি করিল। কহিল, “মা, আমাকে আজকে রাধিতে দাও-না ।” ক্ষেমংকরী একটুখানি হাসিলেন। কহিলেন, “গৃহিণীর রাজত্ব ভাড়ারে আর রান্নাঘরে- জীবনে অনেক জিনিস ছাড়িতে হইয়াছে, তবুওটুকু সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়াই আছে। তা মা, আজকের মতো তুমিই রাধে- দুই-চারিদিন যাক, ক্রমে সমস্ত ভার আপনিই তোমার হাতে পড়িবে, আমিও ভগবানে মন দিবার সময় পাইব । বন্ধন একেবারেই তো কাটে না- এখনো দুই-চারিদিন মন চঞ্চল হইয়া থাকিবে, ভঁড়ার ঘরের সিংহাসনটি কম নয়।” এই বলিয়া ক্ষেমংকরী, কী রাধিতে হইবে, কী করিতে হইবে, কমলাকে সমস্ত উপদেশ দিয়া পূজাগৃহে চলিয়া গেলেন। ক্ষেমংকরীর কাছে আজ কমলার ঘরকন্নার পরীক্ষা আরম্ভ হইল। কমলা তাহার স্বাভাবিক তৎপরতার সহিত রন্ধনের সমস্ত আয়োজন প্ৰস্তুত করিয়া, কোমরে আঁচল জড়াইয়া, মাথায় এলোচুল কুঁটি করিয়া লইয়া রাধিতে প্ৰবৃত্ত হইল।