পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি Ꮤ)ᎶᏔ2 তখন সে আবার আলমারির দরজা বন্ধ করিয়া শয়নগৃহের জানলার কাছে আসিয়া দাড়াইল। বাহিরে আকাশের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে শীতসূর্যাস্তের ক্ষণকালীন আভা মিলাইয়া আসিয়া অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া উঠিল। QWり হেমনলিনী নলিনাক্ষের সহিত বিবাহে সম্মতি দিয়া মনকে বুঝাইতে লাগিল, “আমার পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয় হইয়াছে।” মনে মনে সহস্রাবার করিয়া বলিল, “আমার পুরাতন বন্ধন ছিন্ন হইয়া গেছে, আমার জীবনের আকাশকে বেষ্টন করিয়া যে ঝড়ের মেঘ জমিয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারে কাটিয়া গেছে। এখন আমি স্বাধীন, আমার অতীতকালের অবিশ্রাম আক্রমণ হইতে নির্মুক্ত ৷” এই কথা বারংবার বলিয়া সে একটা বৃহৎ বৈরাগ্যের আনন্দ অনুভব করিল। শ্মশানে দাহকৃত্যের পর এই প্ৰকাণ্ড সংসার তাহার বিপুল ভার পরিহার করিয়া যখন খেলার মতো হইয়া দেখা দেয় তখন কিছুকালের মতো মন যেমন লঘু হইয়া যায়, হেমনলিনীর ঠিক সেই অবস্থা হইল— সে নিজের জীবনের একাংশের নিঃশেষ অবসান-জনিত শান্তি লাভ করিল। বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী ভাবিল, “মা যদি থাকিতেন, তবে তঁহাকে আজ আমার এই আনন্দের কথা বলিয়া আনন্দিত করিতাম, বাবাকে কেমন করিয়া সব কথা বলিব ।” শরীর দুর্বল বলিয়া আজ অন্নদাবাবু যখন সকাল-সকাল শুইতে গেলেন, তখন হেমনলিনী একখানি খাতা বাহির করিয়া রাত্রে তাহার নির্জন শয়নগৃহে টেবিলের উপর লিখিতে লাগিল, “আমি মৃত্যুজালে জড়াইয়া পড়িয়া সমস্ত সংসার হইতে বিযুক্ত হইয়াছিলাম। তাহা হইতে উদ্ধার করিয়া ঈশ্বর আবার যে একদিন আমাকে নূতন জীবনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিবেন তাহা আমি মনেও করিতে পারিতাম না। আজ র্তাহার চরণে সহস্রবার প্রণাম করিয়া নূতন কর্তব্যক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হইলাম। আমি কোনােমতেই যে সৌভাগের উপযুক্ত নই তাঁহাই লাভ করিতেছি। ঈশ্বর আমাকে তাহাই চিরজীবন রক্ষা করিবার জন্য বলদান করুন। র্যাহার জীবনের সঙ্গে আমার এই ক্ষুদ্র জীবন মিলিত হইতে চলিল, তিনি আমাকে সর্বাংশে পরিপূর্ণতা দিবেন, তাহা আমি নিশ্চয়ই জানি ; সেই পরিপূর্ণতার সমস্ত ঐশ্বৰ্য আমি যেন সম্পূর্ণভাবে তাঁহাকেই প্রত্যাৰ্পণ করিতে পারি, এই আমার একমাত্র প্রার্থনা।” কঁকর-বিছানো বাগানের পথে অনেকক্ষণ পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। অনন্ত আকাশ তাহার অশ্রুদ্ধেতি অন্তঃকরণের মধ্যে নিঃশব্দ শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ করিল। পরদিন অপরাহুে যখন অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে লইয়া নলিনাক্ষের বাড়ি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন, এমন সময় তাহার দ্বারের কাছে এক গাড়ি আসিয়া দাড়াইল । কোচাবাক্সের উপর হইতে নলিনাক্ষের এক চাকর নামিয়া আসিয়া খবর দিল, “মা আসিয়াছেন।” অন্নদাবাবু তাড়াতাড়ি দ্বারের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইতেই ক্ষেমংকরী গাড়ি হইতে নামিয়া আসিলেন। অন্নদাবাবু কহিলেন, “আজ আমার পরম সৌভাগ্য।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আজ আপনার মেয়ে দেখিয়া আশীর্বাদ করিয়া যাইব, তাই আসিয়াছি।” এই বলিয়া তিনি ঘরে প্রবেশ করিলেন। অন্নদাবাবু তাহাকে বসিবার ঘরে যত্নপূর্বক একটা সোফার উপরে বসাইয়া কহিলেন, “আপনি বসুন, আমি হেমকে ডাকিয়া আনিতেছি।” হেমনলিনী বাহিরে যাইবার জন্য সাজিয়া প্ৰস্তুত হইতেছিল, ক্ষেমংকরী আসিয়াছেন শুনিয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া তাহাকে প্ৰণাম করিল ; ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সৌভাগ্যবতী হইয়া তুমি দীর্ঘায়ু লাভ করো। দেখি মা, তোমার হাতখানি দেখি ।” বলিয়া একে একে তাহার দুই হাতে মকরমুখো মোটা সোনার বালা দুইগাছি পরাইয়া দিলেন। হেমনলিনীর কৃশ হাতে মোটা বালাজোড়া ঢলঢল করিতে লাগিল। বালা পরানাে হইলে হেমনলিনী আবার ভূমিষ্ঠ হইয়া ক্ষেমংকরীকে প্ৰণাম করিল ; ক্ষেমংকরী দুই হাতে তাহার মুখ ধরিয়া তাহার