পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

i নীেকাডুবি ७४ অন্নদাবাবু কহিলেন, “সময়মত একদিন শুনিব, কিন্তু আজ আমার তো অবকাশ নাই। এখােন আমাকে বাহির হইতে হইবে।” যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে ?” অন্নদাবাবু কহিলেন, “নলিনাক্ষের মা'র ওখানে আমার আর হেমের নিমন্ত্রণ আছে। যোগেন্দ্ৰ, তোমার তা হইলে এখানেই আহারের-” যোগেন্দ্ৰ কহিল, “না না। আমার জন্যে ব্যস্ত হবার দরকার নাই। আমি রমেশকে সঙ্গে লইয়া এখানকার কোনো হােটেলে খাওয়া-দাওয়া করিয়া লইব । সন্ধ্যার মধ্যে তোমরা ফিরিবে তো ? তখনই আমরা আসিব ।” অন্নদাবাবু কোনোমতেই রমেশের প্রতি কোনোপ্রকার শিষ্টসম্ভাষণ করিতে পারিলেন না। তাহার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করাও তঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। রমেশও এতক্ষণ নীরবে থাকিয়া, যাইবার সময় অন্নদাবাবুকে নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। (፩ ዓ ক্ষেমংকরী কমলাকে গিয়া কহিলেন, “মা, কাল হেমকে আর তার ব্যাপকে দুপুরবেলায় এখানে আহার করিতে নিমন্ত্রণ করা গেছে। কী রকম আয়োজনটা করা যায় বলে দেখি । বেয়াইকে এমন { করিয়া খাওয়ানো দরকার যে, তিনি যেন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন যে এখানে তঁহার মেয়েটির খাওয়ার কষ্ট হইবে না। কী বল মা ? তা, তোমার যেরকম রান্নার হাত, অপযশ হইবে না তা জানি। আমার ছেলে আজ পর্যন্ত কোনো রান্না খাইয়া কোনোদিন ভালোমন্দ কিছুই বলে নাই, কাল তোমার রান্নার প্রশংসা তাহার মুখে ধরে নাম। কিন্তু তোমার মুখখনি আজ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে যে ? শরীর কি ভুলাে নাই ?" মলিন মুখে একটুখানি হাসি আনিয়া কমলা কহিল, “বেশ আছি মা !” ক্ষেমংকরী মাথা নাডিয়া কহিলেন, “না না, বোধ করি তোমার মন কেমন করিতেছে। তা-তো করিতেই পারে, সেজন্য লজ্জা কিসের । আমাকে পর ভাবিয়ো না মা ! আমি তোমাকে আপনি মেয়ের মতোই দেখি, এখানে যদি তোমার কোনো অসুবিধা হয়, বা তুমি আপনার লোক কাহাকেও দেখিতে চাও তো আমাকে না বলিলে চলিবে কেন ?” কমলা ব্যগ্ৰ হইয়া কহিল, “না মা, তোমার সেবা করিতে পারিলে আমি আর কিছুই চাই না।” ক্ষেমংকরী সে কথায় কান না দিয়া কহিলেন, “নহয় কিছুদিনের জন্য তোমার খুড়ার বাড়িতে গিয়া থাকে, তার পরে যখন ইচ্ছা হয়। আবার আসিবে ।” | কমলা অস্থির হইয়া উঠিল; কহিল, "মা, আমি যতক্ষণ তােমার কাছে আছি সংসারে কাহারও জন্য | ভাবি না। আমি যদি কখনাে তােমার পায়ে অপরাধ করি আমাকে তুমি যেমন খুশি শান্তি দিয়াে, কিন্তু একদিনের জন্যও দূরে পাঠাইয়াে না।” তুমি আমার মা ছিলে। নহিলে দেখিবামাত্র এমন বন্ধন কী করিয়া হয়। তা, যাও মা, সকাল-সকল ক্ষেমংকরী কমলার দক্ষিণ কপোলে দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া কহিলেন, “তই তো বলি মা, আর জন্মে ঔইতে যাও । সমস্ত দিন তো এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে জান না।” কমলা তাহার শয়নগৃহে গিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, দীপ নিবাইয়া, অন্ধকারে মাটির উপরে বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ বসিয়া, অনেকক্ষণ ভাবিয়া, এই কথা সে মনে বুঝিল- 'কপালের দোষে যাহার উপরে আমার অধিকার হারাইয়াছি তাহাকে আমি আগলাইয়া বসিয়া থাকিব, এ কেমন করিয়া হয়। সমস্তই ছাড়িবার জন্য মনকে প্রস্তুত করিতে হইবে ; কেবল সেবা করিবার সুযোগটুকু, যেমন করিয়া ইউক, প্রাণপণে বঁাচাইয়া চলিব। ভগবান করুন, সেটুকু যেন হাসিমুখে করিতে পারি ; তাহার বেশি আঁর কিছুতে যেন দৃষ্টি না দিই। অনেক দুঃখে যেটুকু পাইয়াছি সেটুকুও যদি প্রসন্ন-মনে না লইতে পারি, যদি মুখ ভার করি, তবে সবসুদ্ধই হারাইতে হইবে।”