পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি VGs এসো মা, এসো। কিন্তু তোমার এ বেশে চলিবে না। তোমার উপযুক্ত সাজে তোমাকে আজ সাজাইব ।” সকল দিকেই ক্ষেমংকরী আজ হেমনলিনীর গর্ব খাটাে করিতে উদ্যত হইয়াছেন । রূপেও তিনি তাহাকে এই অল্পশিক্ষিতা মেয়েটির কাছে স্নান করিতে চান। কমলা আপত্তি করিবার অবকাশ পাইল না। তাহাকে ক্ষেমংকরী নিপুণহস্তে মনের মতো করিয়া সাজাইয়া দিলেন, ফিরোজা রঙের রেশমি শাড়ি পরাইলেন, নূতন ফ্যাশানের খোপা রচনা করিলেন, বার বার কমলার মুখ এ দিকে ফিরাইয়া ও দুঃখিলেন এবং যুদ্ধচন্তে তাহার কােপাল চুনকািরয়া কহিলে,”আহ, এরূপ রাজার घ6 " কমলা মাঝে মাঝে কহিল, “মা, উহারা একলা বসিয়া আছেন, দেরি হইয়া যাইতেছে।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তা, হােক দেরি । আজ আমি তোমাকে না সাজাইয়া যাইব না।” সাজ সারা হইলে তিনি কমলাকে সঙ্গে করিয়া চলিলেন, “এসো এসো মা, লজ্জা করিয়ো না । তোমাকে দেখিয়া কলেজে-পড়া বিদুষী রূপসীরা লজ্জা পাইবেন, তুমি সকলের কাছে মাথা তুলিয়া দাড়াইতে পাের।” এই বলিয়া যে ঘরে অন্নদাবাবুরা বসিয়াছিলেন সেই ঘরে ক্ষেমংকরী জোর করিয়া কমলাকে টানিয়া লইয়া গেলেন । গিয়া দেখিলেন, নলিনাক্ষ তাহদের সঙ্গে আলাপ করিতেছে। কমলা তাড়াতাড়ি ফিরিয়া যাইবার উপক্ৰম করিল, কিন্তু ক্ষেমংকরী তাহাকে ধরিয়া রাখিলেন ; কহিলেন, “লজ কী মা, লজ্জা কিসের ! সব আপনার লোক ৷” কমলার রূপে এবং সজ্জায় ক্ষেমংকরী নিজের মনে একটা গর্ব অনুভব করিতেছিলেন ; তাহাকে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হউক, এই তাহার ইচ্ছা । পুত্ৰাভিমানিনী জননী তাহার নলিনাক্ষের প্রতি হেমনলিনীর অবজ্ঞা কল্পনা করিয়া আজ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন, আজ নলিনাক্ষের কাছেও হেমনলিনীকে খর্ব করিতে পারিলে তিনি খুশি হন। কমলাকে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হইল। হেমনলিনী প্রথম দিন যখন তাহার পরিচয় লাভ করিয়াছিল তখন কমলার সাজসজা কিছুই ছিল না ; সে মলিনভাবে সংকুচিত হইয়া এক ধারে বসিয়া ছিল, তাও বেশিক্ষণ ছিল না। তাহাকে সেদিন ভালো করিয়া দেখাই হয় নাই। আজ মুহুর্তকাল সে বিস্মিত হইয়া রহিল, তাহার পরে উঠিয়া দাড়াইয়া লজ্জিত কমলার হাত ধরিয়া তাহাকে আপনার পাশে বসাইল । ক্ষেমংকরী বুঝিলেন, তিনি জয়লাভ করিয়াছেন ; উপস্থিত-সভায় সকলকেই মনে মনে স্বীকার করিতে হইয়াছে, এমন রূপ দৈবপ্ৰসাদেই দেখিতে পাওয়া যায়। তখন তিনি কমলাকে কহিলেন, “যাও তোমা, তুমি হেমকে তোমার ঘরে লইয়া গল্পসল্প করো গে যাও । আমি ততক্ষণ খাবারের জায়গা করি (5 কমলার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল । সে ভাবিতে লাগিল, “হেমনলিনীর আমাকে কেমন লাগিবে কে জানে ৷” এই হেমনলিনী একদিন এই ঘরের বধু হইয়া আসিবে, কত্রী হইয়া উঠিবে- ইহার সুদৃষ্টিকে কমলা উপেক্ষা করিতে পারে না। এ বাড়ির গৃহিণীপদ তাঁহারই ছিল, কিন্তু সে কথা সে মনেও আনিতে চায় নী- ঈর্ষাকে সে কোনোমতেই অন্তরে স্থান দিবে না । তাহার কোনো দাবি নাই। তাই হেমনলিনীর সঙ্গে যাইবার সময় তাহার পা কঁপিয়া যাইতে লাগিল । , হেমনলিনী আস্তে আস্তে কমলাকে কহিল, “তোমার সব কথা আমি মা'র কাছে শুনিয়াছি। শুনিয়া বড়ো কষ্ট হইল। তুমি আমাকে তোমার বোনের মতো দেখিয়ো ভাই। তোমার কি বােন কেহ আছে ?” আমার একটি খুড়তুতো বােন আছে।” হেমনলিনী কহিল, “ভাই, আমার বোন কেহ নাই। আমি যখন ছোটাে ছিলাম তখন আমার মা