পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVS • Iدr, রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রশ্ন উঠিয়াছে। কথাটা বেশি দূর অগ্রসর হইবার পূর্বে আমার যাহা বক্তব্য আছে, বলিতে ইচ্ছা! " অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঠিক কথা, সে তো বলাই কর্তব্য ।” নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি জানেন না, পূর্বেই আমার বিবাহ হইয়াছে।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “জানি। কিন্তু—” নলিনাক্ষ। আপনি জানেন শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। কিন্তু তাহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ আপনি অনুমান করিতেছেন। নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। এমনকি, তিনি বীচিয়া আছেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি । + অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঈশ্বর করুন, তাহাই যেন সত্য হয়। হেম, হেম।” হেমনলিনী আসিয়া কহিল, “কী বাবা ?” অন্নদাবাবু। রমেশ তোমাকে যে চিঠি লিখিয়াছেন, তাহার মধ্যে যে অংশটুকু— হেমনলিনী সেই চিঠিখানি নলিনাক্ষের হাতে দিয়া কহিল, “এ চিঠির সমস্তটাই উহার পড়িয়া দেখা কর্তব্য ।” এই বলিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল । চিঠিখনি পড়া শেষ করিয়া নলিনাক্ষ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “এমন শোচনীয় ঘটনা সংসারে প্রায় ঘটে না । চিঠিখনি পড়িতে দিয়া আপনার মনে আঘাত দেওয়া হইল। কিন্তু ইহা আপনার কাছে গোপন করাও আমাদের পক্ষে অন্যায় হইত ।” নলিনাক্ষ একটুখানি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া অন্নদাবাবুর কাছে বিদায় লইয়া উঠিল। চলিয়া যাইবার সময় উত্তরের বারান্দায় অদূরে হেমনলিনীকে দেখিতে পাইল । হেমনলিনীকে দেখিয়া নলিনাক্ষের মনে আঘাত লাগিল। ঐ-যে নারী স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া, উহার স্থির-শাস্ত মূর্তিটি উহার অন্তঃকরণকে কেমন করিয়া বহন করিতেছে ? এই মুহুর্তে উহার মন যে কী করিতেছে তাহা ঠিকমত জানিবার কোনো উপায় নাই ; নলিনাক্ষকে তাহার কোনো প্রয়োজন আছে কি না সে প্রশ্নও করা যায় না, তাহার উত্তর পাওয়াও কঠিন । নলিনাক্ষের পীড়িত চিত্ত ভাবিতে লাগিল, ইহাকে কোনো সাত্মনা দেওয়া যায় কি না। কিন্তু মানুষে মানুষে কী দুর্ভেদ্য ব্যবধান ! মন জিনিসটা কী ভয়ংকর একাকী ! নলিনাক্ষ একটু ঘুরিয়া ঐ বারান্দার সামনে দিয়া গাড়িতে উঠিবে স্থির করিল, মনে করিল যদি হেমনলিনী তাহাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে। বারান্দার সম্মুখে যখন আসিল, দেখিল হেমনলিনী বারান্দা ছাড়িয়া ঘরের মধ্যে সরিয়া গেছে। হৃদয়ের সহিত হৃদয়ের সাক্ষাৎ সহজ নহে, মানুষের সহিত মানুষের সম্বন্ধ সরল নহে, এই কথা চিন্তা করিয়া ভারাক্রান্তচিত্তে নলিনাক্ষ গাড়িতে উঠিল। নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে যোগেন্দ্ৰ আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, "কী যোগেন, একলা যে ?” যোগেন্দ্ৰ কহিল, “দ্বিতীয় আর কোন ব্যক্তিকে প্রত্যাশা করিতেছ। শুনি ?” অন্নদা কহিলেন, “কেন ? রমেশ ?” যোগেন্দ্র । তাহার প্রথম দিনের অভ্যর্থনাটাই কি ভদ্রলোকের পক্ষে যথেষ্ট হয় নাই। কাশীর গঙ্গায় ঝাপ দিয়া মরিয়া যদি তাহার শিবত্বলাভ না হইয়া থাকে, তবে আর কী হইয়াছে আমি নিশ্চয় জানি না। কাল হইতে এ পর্যন্ত তাহার আর দেখা নাই, টেবিলে একখানা কাগজে লেখা আছে— ‘পালাই— তোমার রমেশ।” এ সব কবিত্ব আমার কোনােকালে অভ্যাস নাই। সুতরাং আমাকেও এখান হইতে পলাইতে হইল, আমার হেডমাস্টারিই ভালো, তাহাতে সমস্তই খুব স্পষ্ট— ঝাপসা কিছুই নাই | অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমের জন্য তো একটা-কিছু স্থির-” যোগেন্দ্র। আর কেন ? আমিই কেবল স্থির করিব, আর তোমরা অস্থির করিতে থাকিবে, এ খে? বেশি দিন ভালাে লাগে না। আমাকে আর-কিছুতে জড়াইয়াে না— আমি যাহা ভালো বুঝিতে পার্ট না, সেটা আমার ধাতে সয় না। হঠাৎ দুর্বোিধ হইয়া পড়বার যে আশ্চর্য ক্ষমতা হেমের আছে, "