পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVy রবীন্দ্র-রচনাবলী বিছানা করিয়া বাহির হইয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ নলিনাক্ষের পায়ের শব্দ শুনিয়া তাড়াতাড়ি বিছানার ও পাশে গিয়া লুকাইয়াছিল— এখন পালানোও অসম্ভব, লুকানোও কঠিন। তাহার রাশীকৃত-লজা-সমেত এই ধূলির উপরে সে এমন একান্তভাবে ধরা পড়িয়া গেল । নলিনাক্ষ এই লজ্জিতাকে মুক্তি দিবার জন্য তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্ৰম করিল। দরজা পর্যন্ত গিয়া একবার দাড়াইল । কিছুক্ষণ কী ভাবিয়া সে ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিল ; কমলার সম্মুখে দাড়াইয়া কহিল, “তুমি ওঠে, আমার কাছে তোমার কোনো লজ্জা নাই।” や> পরদিন সকালেই কমলা খুড়ামশায়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। যখন নির্জনে একটু অবকাশ দুঃস্থন দেশগঙ্গাঙ্কে জড়ইয়াখািল শৈল কেলর সুরু কেয়কলি কী বেন এত ঘূর্ণ চলিয়া গেছে ।” শৈলী। বল-না, সব কথা বল-না। আমাকে । এই তো কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ছিলাম, তার পরে তোর হইল কী ? |- কমলা। এমন কিছুই হয় নাই, কিন্তু আমার কেবলই মনে হইতেছে, আমি যেন তাহাকে পাইয়াছি, ঠাকুর যেন আমার পরে সদয় হইয়াছেন । শৈল । তাই হােক বোন, কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকোস নে । কমলা। আমার লুকাইবার কিছুই নাই দিদি, কী যে বলিবার আছে, তাও খুঁজিয়া পাই না। রাত পোহাইতেই সকলে উঠিয়া মনে হইল আমার জীবনটা সার্থক- আমার সমস্ত দিনটা এমন মিষ্ট, আমার সমস্ত কাজ এমন হালকা হইয়া গেছে, তাহা আমি বলিতে পারি না । আমি ইহার চেয়ে আর বেশি কিছুই চাই না- কেবল ভয় হয় পাছে এটুকু নষ্ট হয়— আমি যে প্রতিদিন এমন করিয়া দিন কটাইতে পারিব, আমার ভাগ্য যে এত প্ৰসন্ন হইবে, তাহা আমি মনে করিতেই পারি না । শৈল । আমি তোকে বলিতেছি বোন, তোর ভাগ্য তোকে এইটুকু দিয়াই ফাকি দিবে না, তোর যাহা পাওনা আছে তার সমস্তই শোধ হইবে । কমলা । না না দিদি, ও কথা বলিয়ে না— আমার সমস্ত শোধ হইয়াছে, আমি বিধাতাকে কোনো দোষ দিই না, আমার কোনো অভাব নাই । 翁 এমন সময় খুড়া আসিয়া কহিলেন, “মা, তোমাকে তো একবার বাহিরে আসিতে হইতেছে, রমেশবাবু আসিয়াছেন।” খুড়া এতক্ষণ রমেশের সঙ্গেই কথা কহিতেছিলেন। রমেশকে বলিতেছিলেন, “আপনার সঙ্গে কমলার কী সম্বন্ধ, তাহা আমি সমস্তই জানিয়াছি। এখন আপনার প্রতি আমার পরামর্শ এই যে, আপনার জীবন এখন পরিষ্কার হইয়া গেছে, এখন আপনি কমলার সমস্ত প্রসঙ্গ একেবারে পরিত্যাগ করুন | কমলা সম্বন্ধে যদি কোনো গ্ৰন্থি কোথাও মোচন করিবার প্রয়োজন থাকে। তবে বিধাতার উপর সে ভার দিন, আপনি আর হাত দিবেন না ।” রমেশ ইহার উত্তরে কহিতেছিল, “কমলা সম্বন্ধে সকল কথা নিঃশেষে পরিত্যাগ করিবার পূর্বে নলিনাক্ষের কাছে সকল ঘটনা না জানাইয়া আমার নিস্কৃতি হইতেই পারে না। এ পৃথিবীতে কমলার কথা তুলিবার সমস্ত প্রয়োজন হয়তো শেষ হইয়া গেছে, হয়তো শেষ হয় নাই— যদি না হইয়া থাকে তবে আমার যেটুকু বক্তব্য সেটুকু সারিয়া ছুটি পাইতে চাই ।” খুড়া কহিলেন, “আচ্ছা, আপনি একটুখানি বসুন, আমি আসিতেছি।” রমেশ ঘুরিয়া বসিয়া জানলা হইতে শূন্যদৃষ্টিতে লোকপ্রবাহের দিকে চাহিয়া রহিল ; কিছুক্ষণ পরেই পায়ের শব্দে সতর্ক হইয়া দেখিল, একটি রমণী ভূমিতে মাথা ঠেকাইয়া তাহাকে প্ৰণাম করিল। যখন