পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি OAS পাইয়াছে, কিন্তু সে আপনার সুগভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া চলিয়া গেল, কেবল একটা-কী রাখিয়া গেল যাহা বিলীয়মান গােধূলির মতো অপরিমেয় বিষাদের বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ। গৃহকর্মের অবকাশকালে আজ সমস্ত দিন কেবল হেমনলিনীর কথাগুলি এবং তাহার শাস্ত-সকরুণ । চোখের দৃষ্টি কমলার মনকে আঘাত দিতে লাগিল। কমলা হেমনলিনীর জীবনের আর-কোনো ঘটনা জানিত না- কেবল জানিত, নলিনাক্ষের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়া ভাঙিয়া গেছে। হেমনলিনী তাঁহাদের বাগান হইতে আজ এক সাজি ফুল আনিয়া দিয়াছিল। বৈকালে গা ধুইয়া আসিয়া কমলা সেই ফুলগুলি লইয়া মালা গাঁথিতে বসিল । মাঝে একবার ক্ষেমংকরী আসিয়া তাহার পাশে বসিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আহা মা, আজ হেম যখন আমাকে প্ৰণাম করিয়া চলিয়া গেল, আমার মনের মধ্যে যে কী করিতে লাগিল বলিতে পারি না । যে যাই বলুক, হেম মেয়েটি বড়ো ভালো। আমার এখন কেবলই মনে হইতেছে, উহাকে যদি আমাদের বউ করিতাম তো বড়ো সুখের হইত। আর-একটু হইলেই তো হইয়া যাইত, কিন্তু আমার ছেলেটিকে তো পারিবার জো নাই- ও যে কী ভাবিয়া বাকিয়া বসিল তা সে ওই জানে ৷” শেষকালে তিনিও যে এই বিবাহের প্রস্তাবে বিমুখ হইয়াছিলেন সে কথা ক্ষেমংকরী আর মনের মধ্যে আমল দিতে চান না । বাহিরে পায়ের শব্দ শুনিয়া ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, “ও নলিন, শুনে যা ।” কমলা তাড়াতাড়ি আঁচলের মধ্যে ফুল ও মালা ঢাকিয়া ফেলিয়া মাথায় কাপড় তুলিয়া দিল । নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিলে ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হেমরা যে আজ চলিয়া গেল । তোর সঙ্গে কি দেখা হয় নাই ?” A নলিন কহিল, “হা, আমি যে তাঁহাদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আসিলাম।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “যাই বলিস বাপু, হেমের মতো মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না ।” যেন নলিনাক্ষ এ সম্বন্ধে বরাবর তাহার প্রতিবাদ করিয়াই আসিয়াছে। নলিনাক্ষ চুপ করিয়া একটুখানি হাসিল । ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হাসলি যে বড়ো ! আমি তোর সঙ্গে হেমের সম্বন্ধ করিলাম, আশীর্বাদ পর্যন্ত করিয়া আসিলাম, আর তুই যে জেদ করিয়া সব ভণ্ডুল করিয়া দিলি, এখন তোর মনে কি একটু অনুতাপ হইতেছে না ?” নলিনাক্ষ একবার চকিতের মতো কমলার মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল ; দেখিল, কমলা উৎসুকনেত্ৰে তাহার দিকে তাকাইয়া আছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবামাত্ৰ কমলা লজ্জায় মাটি হইয়া চােখ নিচু করিল। নলিনাক্ষ কহিল, “মা, তােমার ছেলে কি এমনি সৎপাত্র যে, তুমি সম্বন্ধ করিলেই হইল ? আমার মতো নীরস গভীর লোককে সহজে কি কারও পছন্দ হইতে পারে ।” এই কথায় কমলার চোখ আপনি আবার উপরে উঠিল, উঠিবামাত্ৰ দেখিল নলিনাক্ষের হাস্যোেজল ৪ জুলু উপরেই পডিয়াছে– এবার কমলার মনে হইতে লাগিল ঘর ইত চুটিয়া পালাইতে রলে বাচি” । ক্ষেমংকরী কহিলেন, “যা যা, আর বকিস নে, তোর কথা শুনিলে আমার রাগ ধরে ।” এই সভা ভঙ্গ হইয়া গেলে পর কমলা হেমনলিনীর সব ক'টি ফুল লইয়া একটি বড়ো মালা গীথিল । ফুলের সাজির উপরে সেই মালাটি লইয়া জলের ছিটা দিয়া সেটি নলিনাক্ষের উপাসনা-ঘরের এক পার্থে রাখিয়া দিল । তাহার মনে হইতে লাগিল, আজ বিদায় হইয়া যাইবার দিনে এইজন্যই হেমনলিনী সাজি ভরিয়া ফুল আনিয়াছিল— মনে করিয়া তাহার চােখ ছল ছল করিয়া উঠিল। তাহার পরে আপনার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া তাহার মুখের দিকে নলিনাক্ষের সেই দৃষ্টিপাত কমলা অনেকক্ষণ ধরিয়া আলোচনা করিতে লাগিল । নলিনাক্ষ কমলাকে কী মনে করিতেছে ? কমলার মনের কথা যেন নলিনাক্ষের কাছে সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। কমলা পূর্বে যখন নলিনাক্ষের সম্মুখে