পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Sr. ܛ বর্ষার সন্ধ্যায় আকাশের অন্ধকার যেন ভিজিয়া ভারী হইয়া পড়িয়াছে। বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন মেঘের নিঃশব্দ শাসনের নীচে কলিকাতা শহর একটা প্রকাণ্ড নিরানন্দ কুকুরের মতো লেজের মধ্যে মুখ গুজিয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। কাল সন্ধ্যা হইতে টিপ টপ করিয়া কেবলই বর্ষণ হইয়াছে; সে বৃষ্টিতে রাস্তার মাটিকে কাদা করিয়া তুলিয়াছে কিন্তু কাদাকে ধুইয়া ভাসাইয়া লইয়া যাইবার মতো বল প্রকাশ করে নাই। আজ বেলা চারটি হইতে বৃষ্টি বন্ধ আছে, কিন্তু মেঘের গতিক ভালো নয়। এইরূপ আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় সন্ধ্যাবেলায় নির্জন ঘরের মধ্যে যখন মন টেকে না এবং বাহিরেও যখন আরাম পাওয়া যায় না। সেই সময়টাতে দুটি লোক একটি তেতলা বাড়ির সঁ্যাতসেঁতে ছাতে দুটি বেতের মোড়ার উপর বসিয়া আছে। এই দুই বন্ধু যখন ছােটাে ছিল তখন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই ছাতে ছুটাছুটি খেলা করিয়াছে ; পরীক্ষার পূর্বে উভয়ে চীৎকার করিয়া পড়া আবৃত্তি করিতে করিতে এই ছাতে দ্রুতপদে পাগলের মতো পায়চারি করিয়া বেড়াইয়াছে; গ্ৰীষ্মকালে কলেজ হইতে ফিরিয়া রাত্রে এই ছাতের উপরেই আহার করিয়াছে, তার পরে তর্ক করিতে করিতে কতদিন রাত্রি দুইটা হইয়া গেছে এবং সকালে রৌদ্র আসিয়া যখন তাহাদের মুখের উপর পড়িয়াছে তখন চমকিয়া জাগিয়া উঠিয়া দেখিয়াছে, সেইখানেই মাদুরের উপরে দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িয়ছিল। কলেজে পাস করা যখন একটাও আর বাকি রহিল না। তখন এই ছাতের উপরে মাসে একবার করিয়া যে হিন্দুহিতৈষী সভার অধিবেশন হইয়া আসিয়াছে এই দুই বন্ধুর মধ্যে একজন তাহার সভাপতি এবং আর-এক জন তাহার সেক্রেটরি। যে ছিল সভাপতি তাহার নাম গৌরমোহন ; তাহাকে আত্মীয়বন্ধুরা গোরা বলিয়া ডাকে। সে চারি দিকের সকলকে যেন খাপছাড়া রকমে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে তাহার কলেজের পণ্ডিতমহাশয় রজতগিরি বলিয়া ডাকিতেন। তাহারাগায়ের রঙটা কিছু উগ্র রকমের সাদা- হলদের আভা তাহাকে একটুও স্নিগ্ধ করিয়া আনে নাই। মাথায় সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা, হাড় চওড়া, দুই হাতের মুঠা যেন বাঘের থাবার মতো বড়ো— গলার আওয়াজ এমনি মোটা ও গভীর যে হঠাৎ শুনিলে “কে রে” বলিয়া চমকিয়া উঠিতে হয়। তাহার মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো এবং অতিরিক্ত রকমের মজবুত ; চােয়াল এবং চিবুকের হাড় যেন দুৰ্গদ্বারের দৃঢ় অর্গলের মতো ; চােখের উপর ভূরেখা নাই বলিলেই হয় এবং সেখানকার কপালটা কানের দিকে চওড়া হইয়া গেছে। ওষ্ঠাধর পাতলা এবং চাপা ; তাহার উপরে নাকটা খাড়ার মতো কুঁকিয়া আছে। দুই চােখ ছােটাে কিন্তু তীক্ষা ; তাহার দৃষ্টি যেন তীরের ফলাটার মতো অতিদূর অদৃশ্যের দিকে লক্ষ ঠিক করিয়া আছে অথচ এক মুহূর্তের মধ্যেই ফিরিয়া আসিয়া কাছের জিনিসকেও বিদ্যুতের মতো আঘাত করিতে পারে। গীেরকে দেখিতে ঠিক সুশ্ৰী বলা যায় না, কিন্তু তাহাকে না দেখিয়া থাকিবার জো নাই, সে সকলের মধ্যে চোখে পড়িবেই। আর তাহার বন্ধু বিনয় সাধারণ বাঙালি শিক্ষিত ভদ্রলোকের মতো নম্র, অথচ উজ্জ্বল ; স্বভাবের সীেকুমাৰ্য ও বুদ্ধির প্রখরতা মিলিয়া তাহার মুখশ্ৰীতে একটি বিশিষ্টতা দিয়াছে। কলেজে সে বরাবরই উচ্চ নম্বর ও বৃত্তি পাইয়া আসিয়াছে ; গোরা কোনোমতেই তাহার সঙ্গে সমান চলিতে পারিত না। পাঠ্যবিষয়ে গোরার তেমন আসক্তিই ছিল না ; বিনয়ের মতো সে দ্রুত বুঝিতে এবং মনে রাখিতে পারিত না । বিনয়ই তাহার বাহন হইয়া কলেজের পরীক্ষা কয়টার ভিতর দিয়া নিজের পশ্চাতে, তাহাকে টানিয়া পার করিয়া আনিয়াছে। গোরা বলিতেছিল, “শোনো বলি। অবিনাশ যে ব্ৰাহ্মদের নিন্দে করছিল, তাতে এই বোঝা যায় যে লোকটা বেশ সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। এতে তুমি হঠাৎ অমন খাপা হয়ে উঠলে কেন ?” বিনয়। কী আশ্চর্য। এ সম্বন্ধে যে কোনো প্রশ্ন চলতে পারে তাও আমি মনে করতে পারতুম না। গোরা । তা যদি হয় তবে তোমার মনে দোষ ঘটেছে। এক দল লোক সমাজের বঁাধন ছিড়ে সব বিষয়ে উলটােরকম করে চলবে। আর সমাজের লোক অবিচলিতভাবে তাদের সুবিচার করবে। এ