পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏔᏱᏓr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বভাবের নিয়ম নয়। সমাজের লোকে তাদের ভুল বুঝবেই, তারা সোজা ভাবে যেটা করবে। এদের চোখে সেটা বঁকা ভাবে পড়বেই, তাদের ভালো এদের কাছে মন্দ হয়ে দাড়াবেই, এইটেই হওয়া উচিত । ইচ্ছামত সমাজ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার যতগুলো শান্তি আছে। এও তার মধ্যে একটা । বিনয় । যেটা স্বাভাবিক সেইটেই যে ভালো, তা আমি বলতে পারি। নে । গোরা একটু উষ্ণ হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমার ভালোয় কাজ নেই। পৃথিবীতে ভালো দু-চারজন যদি থাকে তো থাক। কিন্তু বাকি সবাই যেন স্বাভাবিক হয়। নইলে কাজও চলে না, প্রাণও বঁাচে না। ব্ৰাহ্ম হয়ে বাহাদুরি করবার শখ যাদের আছে অব্রাহ্মীরা তাদের সব কাজেই ভুল বুঝে নিন্দে করবে এটুকু দুঃখ তাদের সহ্য করতেই হবে। তারাও বুক ফুলিয়ে বেড়াবে আর তাদের বিরুদ্ধ পক্ষও তাদের পিছন পিছন বাহবা দিয়ে চলবে জগতে এটা ঘটে না, ঘটলেও জগতের সুবিধে হত না ।” বিনয় । আমি দলের নিন্দের কথা বলছি নে- ব্যক্তিগতগোরা । দলের নিন্দে আবার নিন্দে কিসের ! সে তো মতামত-বিচার। ব্যক্তিগত নিন্দেই তো চাই। আচ্ছা সাধুপুরুষ, তুমি নিন্দে করতে না ? বিনয় । করতুম। খুবই করতুম— কিন্তু সেজন্যে আমি লজ্জিত আছি। গোরা তাহার ডান হাতের মুঠ শক্ত করিয়া কহিল, “না বিনয়, এ চলবে না, কিছুতেই না।” বিনয় কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তার পরে কহিল, “কেন, কী হয়েছে ? তোমার ভয় কিসের ?” গোরা। আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। তুমি নিজেকে দুর্বল করে ফেলছি। বিনয় ঈষৎ একটুখানি উত্তেজিত হইয়া কহিল, “দুর্বল ! তুমি জান, আমি ইচ্ছে করলে এখনই তাদের বাড়ি যেতে পারি— তারা আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন- কিন্তু আমি যাই নি ।” গোরা । কিন্তু এই যে যাও নি সেই কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না । দিনরাত্রি কেবল ভাবিছ, যাই নি, যাই নি, আমি তাদের বাড়ি যাই নি— এর চেয়ে যে যাওয়াই ভালো । বিনয় । তবে কি যেতেই বল ? 崎 গোরা নিজের জানু চাপড়াইয়া কহিল, “না, আমি যেতে বলি নে। আমি তোমাকে লিখে পড়ে দিচ্ছি, য়েদিন তুমি যাবে সেদিন একেবারে পুরোপুরিই যাবে। তার পরদিন থেকেই তাদের বাড়ি খানা শুরু করবে এবং ব্রহ্মসমাজের খাতায় নাম লিখিয়ে একেবারে পবিজয়ী প্রচারক হল " বিনয় । বল কী ! তার পরে ? গোরা। আর তার পরে ! মরার বাড়া তো গাল নেই। ব্ৰাহ্মণেব ছেলে হয়ে তুমি গো-ভাগাড়ে গিয়ে মরবে, তোমার আচার-বিচার কিছুই থাকবে না, কম্পাসা-ভাঙা কাণ্ডারীর মতো তোমার পূর্ব-পশ্চিমের জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে- তখন মনে হবে জাহাজ বন্দরে উত্তীর্ণ করাই কুসংস্কার, সংকীর্ণতা— কেবল না-হক ভেসে চলে যাওয়াই যথার্থ জাহাজ চালানাে। কিন্তু এসব কথা নিয়ে বকবিকি করতে আমার ধৈর্য থাকে না— আমি বলি তুমি যাও। অধঃপাতের মুখের সামনে পা বাড়িয়ে দাড়িয়ে থেকে আমাদের সুদ্ধ কেন ভয়ে-ভয়ে রেখে দিয়েছ ?” বিনয় হাসিয়া উঠিল, কহিল, “ডাক্তার আশা ছেড়ে দিলেই যে রোগী সব সময়ে মরে তা নয়। আমি তো নিদেন-কালের কোনো লক্ষণ বুঝতে পারছি নে ৷” গোরা । পারছি না ? বিনয় । না । গোরা । নাড়ী ছাড়ে-ছাড়ে করছে না ? বিনয় । না, দিব্যি জোর আছে। গোরা । মনে হচ্ছে না যে, শ্ৰীহস্তে যদি পরিবেশন করে তবে স্নেচ্ছের অন্নই দেবতার ভোগ ? বিনয় অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল, কহিল, “গোরা, বস, এইবার থামো।” গোরা। কেন, এর মধ্যে তো আবরুর কোনাে কথা নেই। শ্ৰীহস্ত তো অসূৰ্যাম্পশ্য নয়।