পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা \Obyr (? পুরুষমানুষের সঙ্গে যার শেকহ্যান্ড চলে সেই পবিত্র করপল্লবের উল্লেখটি পর্যন্ত যখন তোমার সহ্য হল না, তদা নাশিংসে মরণায় সঞ্জয় ! বিনয় । দেখো গোরা, আমি স্ত্রীজাতিকে ভক্তি করে থাকি- আমাদের শাস্ত্ৰেওগোরা। স্ত্রীজাতিকে যে ভাবে ভক্তি করছি তার জন্যে শাস্ত্রের দোহাই পোড়ো না! ওকে ভক্তি বলে না, যা বলে তা যদি মুখে আনি তো মারতে আসবে। বিনয় । এ তুমি গায়ের জোরে বলছি। গোরা। শাস্ত্ৰে মেয়েদের বলেন ‘পূজাহাঁ গৃহদ্দীপ্তয়ঃ' । তঁরা পূজাহাঁ, কেননা গৃহকে দীপ্তি দেন। পুরুষমানুষের হৃদয়কে দীপ্ত করে তোলেন বলে বিলিতি বিধানে তঁদের যে মান দেওয়া হয় তাকে পূজা না বললেই ভালো হয় । বিনয় । কোনো কোনো স্থলে বিকৃতি দেখা যায় বলে কি একটা বড়ো ভাবের উপর ওরকম । কটাক্ষপাত করা উচিত ! গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনু এখন যখন তোমার বিচার করবার বুদ্ধি গেছে তখন আমার কথাটা মেনেই নাও। আমি বলছি বিলিতি শাস্ত্ৰে স্ত্রীজাতি-সম্বন্ধে যে-সমস্ত অত্যক্তি আছে তার ভিতরকার কথাটা হচ্ছে বাসনা। স্ত্রীজাতিকে পুজো করবার জায়গা হল মা’র ঘর, সতীলক্ষ্মী গৃহিণীর আসন । সেখান থেকে সরিয়ে এনে তাদের যে স্তব করা হয়, তার মধ্যে অপমান লুকিয়ে আছে। পতঙ্গের মতো তোমার মনটা যে-কারণে পরেশবাবুর বাড়ির চারিদিকে ঘুরছে, ইংরাজিতে তাকে বলে থাকে ‘লাভ — কিন্তু ইংরেজের নকল ঐ "লাভ' ব্যাপারটাকেই সংসারের মধ্যে একটা চরম পুরুষাৰ্থ বলে উপাসনা করতে হবে, এমন বাদরামি যেন তোমাকে না পেয়ে বসে !” বিনয় কশাহত তাজা ঘোড়ার মতো লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “আঃ গােরা, থাক, যথেষ্ট হয়েছে।” গোরা। কোথায় যথেষ্ট হয়েছে! কিছুই হয় নি। স্ত্রী আর পুরুষকে তাদের স্বস্থানে বেশ সহজ করে দেখতে শিখি নি বলেই আমরা কতকগুলো কবিত্ব জমা করে তুলেছি। বিনয় কহিল, “আচ্ছা, মানছি স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ ঠিক যে জায়গাটাতে থাকলে সহজ হতে পারত আমরা প্রবৃত্তির ঝোকে সেটা লঙ্ঘন করি এবং সেটাকে মিথ্যে করে তুলি, কিন্তু এই অপরাধটা কি কেবল বিদেশেরই ? এ সম্বন্ধে ইংরেজের কবিত্ব যদি মিথ্যে হয় তো আমরা ঐ যে কামিনীকাঞ্চনত্যাগ নিয়ে সর্বদা বাড়াবাড়ি করে থাকি সেটাও তো মিথ্যে । মানুষের প্রকৃতি যা নিয়ে সহজে আত্মবিস্মৃতি হয়ে পড়ে তার হাত থেকে মানুষকে বাচাবার জন্যে কেউ বা প্রেমের সৌন্দৰ্য-অংশকেই কবিত্বের দ্বারা উজ্জ্বল করে তুলে তার মন্দটাকে লজ্জা দেয়, আর কেউ বা ওর মন্দটাকেই বড়ো করে তুলে কামিনীকাঞ্চনত্যাগের বিধান দিয়ে থাকে ; ও দুটাে কেবল দুই ভিন্ন প্রকৃতির লোকের ভিন্নরকম প্ৰণালী । একটাকেই যদি নিন্দে কর তবে অন্যটাকেও রেয়াত করলে চলবে না ।” গোরা । নাঃ, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলুম। তোমার অবস্থা তেমন খারাপ হয় নি। এখনো যখন ফিলজফি তোমার মাথায় খেলছে তখন নিৰ্ভয়ে তুমি “লাভ করতে পারো, কিন্তু সময় থাকতে নিজেকে সামলে নিয়ো— হিতৈষী বন্ধুদের এই অনুরোধ । বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আঃ, তুমি কি পাগল হয়েছ! আমার আবার "লাভ'। তবে এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, পরেশবাবুদের আমি যেটুকু দেখেছি এবং ওঁদের সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে ওঁদের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হয়েছে। বোধ করি তাই ওঁদের ঘরের ভিতরকার জীবনযাত্ৰাট কী রকম সেটা জািনবার জন্যে আমার একটা আকর্ষণ হয়েছিল।” গোরা। উত্তম কথা, সেই আকর্ষণটাই সামলে চলতে হবে। ওঁদের সম্বন্ধে প্ৰাণিবৃত্তান্তের অধ্যায়টা নাহয় অনাবিষ্কৃতই রইল। বিশেষত ওঁরা হলেন শিকারী প্ৰাণী, ওঁদের ভিতরকার ব্যাপার জানতে গিয়ে শেষকালে এত দূর পর্যন্ত ভিতরে যেতে পাের যে তোমার টিকিট পর্যন্ত দেখবার জো থাকবে না। বিনয় । দেখো, তোমার একটা দোষ আছে। তুমি মনে কর যত কিছু শক্তি ঈশ্বর কেবল একলা তোমাকেই দিয়েছেন, আর আমরা সবাই দুর্বল প্রাণী ।