পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ovs রবীন্দ্র-রচনাবলী কথাটা গোরাকে হঠাৎ যেন নূতন করিয়া ঠেকিল ; সে উৎসােহবেগে বিনয়ের পিঠে এক চাপড় মারিয়া কহিল, “ঠিক বলেছ— ঐটে আমার দোষ— আমার মস্ত দোয ।” বিনয় । উঃ, ওর চেয়েও তোমার আর-একটা মস্ত দোষ আছে। অন্য লোকের শিরদাঁড়ার উপরে কতটা আঘাত সয় তার ওজনবোধ তোমার একেবারেই নেই । এমন সময় গোরার বড়ো বৈমাত্র ভাই মহিম তাহার পরিপুষ্ট শরীর লইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরা ।” মহিম । দেখতে এলেম বর্ষার জলধরপটল আমাদের ছাতের উপরে গর্জন করতে নেমেছে কি না। আজ ব্যাপারখানা কী ? ইংরেজকে বুঝি এতক্ষণে ভারত-সমুদ্রের অর্ধেকটা পথ পার করে দিয়েছ ? ইংরেজের বিশেষ কোনো লোকসান দেখছি নে, কিন্তু নীচের ঘরে মাথা ধরে বড়োবউ পড়ে আছে, সিংহনাদে তারই যা অসুবিধে হচ্ছে। এই বলিয়া মহিম নীচে চলিয়া গেলেন । গোরা লজ্জা পাইয়া দাড়াইয়া রহিলা- লজ্জার সঙ্গে ভিতরে একটু রাগও জ্বলিতে লাগিল, তাহা নিজের বা অন্যের পরে ঠিক বলা যায় না। একটু পরে সে ধীরে ধীরে যেন আপন মনে কহিল, “সব বিষয়েই, যতটা দরকার আমি তার চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়ে ফেলি, সেটা যে অন্যের পক্ষে কতটা অসহ্য তা আমার ঠিক মনে থাকে না।” বিনয় গীেরের কাছে আসিয়া সস্নেহে তার হাত ধরিল। \) গোরা ও বিনয় ছাত হইতে নামিয়া যাইবার উপক্ৰম করিতেছে এমন সময় গোরার মা উপরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । বিনয় তাহার পায়ের ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিল। গোরার মা আনন্দময়ীকে দেখিলে গোরার মা বলিয়া মনে হয় না। তিনি ছিপছিপে পাতলা, আঁটর্সাট ; চুল যদি বা কিছু কিছু পাকিয়া থাকে বাহির হইতে দেখা যায় না ; হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় তাহার বয়স চল্লিশেরও কম । মুখের বেড় অত্যন্ত সুকুমার, ন্যাকের ঠোঁটের চিবুকের ললাটের রেখা কে যেন যত্নে কুঁদিয়া কাটিয়াছে ; শরীরের সমস্তই বাহুল্যবর্জিত | মুখে একটি পরিষ্কার ও সতেজ বুদ্ধির ভাব সর্বদাই প্রকাশ পাইতেছে। রঙ শ্যামবর্ণ, গোরার রঙের সঙ্গে তাহার কোনোই তুলনা হয় না। তাহাকে দেখিবামাত্রই একটা জিনিস সকলের চোখে পড়ে— তিনি শাড়ির সঙ্গে শেমিজ পরিয়া থাকেন । আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনকার দিনে মেয়েদের জামা বা শেমিজ পরা যদিও নবদলে প্রচলিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। তবু প্ৰবীণা গৃহিণীরা তাহাকে নিতান্তই খৃস্টানি বলিয়া অগ্রাহ্য করিতেন । আনন্দময়ীর স্বামী কৃষ্ণদয়ালবাবু কমিসেরিয়েটে কাজ করিতেন, আনন্দময়ী তাহার সঙ্গে ছেলেবেলা হইতে পশ্চিমে কাটাইয়াছেন, তাই ভালো করিয়া গা ঢাকিয়া গায়ে কাপড় দেওয়া যে লজ্জা বা পরিহাসের বিষয় এ সংস্কার তাহার মনে স্থান পায় নাই। ঘরদুয়ার মজিয়া ঘষিয়া, ধুইয়া মুছিয়া, রাধিয়া বাড়িয়া, সেলাই করিয়া, গুনতি করিয়া, হিসাব করিয়া, ঝাড়িয়া, রৌদ্ৰে দিয়া, আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীর খবর লইয়া, তবু তাহার সময় যেন ফুরাইতে চাহে না । শরীরে অসুখ করিলে তিনি কোনোমতেই তাহাকে আমল দিতে চান না— বলেন, “অসুখে তো আমার কিছু হবে না, কাজ না করতে পেলে বীচব কী করে ?” গোরার মা উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরার গলা যখনই নীচে থেকে শোনা যায় তখনই বুঝতে পারি বিনু নিশ্চয়ই এসেছে। ক'দিন বাড়ি একেবারে চুপচাপ ছিল— কী হয়েছে বল তো বাছা ? আসিস নি কেন, অসুখবিসুখ করে নি তো ?” বিনয় কুষ্ঠিত হইয়া কহিল, “না, মা, অসুখ না— যে বৃষ্টিবাদল !”