পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\OSV র্যােন্দা-রচনাবলী আজ আহ্নিক ও স্নানাহার সারিয়া কৃষ্ণদয়াল অনেক দিন পরে আনন্দময়ীর ঘরের মেজের উপর নিজের কম্বলের আসনটি পাতিয়া সাবধানে চারিদিকের সমস্ত সংস্রব হইতে যেন বিবিজ্ঞা হইয়া খাড়া হইয়া বসিলেন । আনন্দময়ী কহিলেন, “ওগো, তুমি তো তপস্যা করছ, ঘরের কথা কিছু ভাব না, কিন্তু আমি যে গোরার জন্যে সর্বদাই ভয়ে ভয়ে গেলুম !" কৃষ্ণদয়াল। কেন, ভয় কিসের ? আনন্দময়ী। তা আমি ঠিক বলতে পারি নে। কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে, গোরা আজকাল এই যে হিন্দুয়ানি আরম্ভ করেছে এ ওকে কখনোই সইবে না, এ ভাবে চলতে গেলে শেষকালে একটা কী বিপদ ঘটবে। আমি তো তোমাকে তখনই বলেছিলুম, ওর পাইতে দিয়ে না। তখন যে তুমি কিছুই মানতে না ; বললে, গলায় একগাছা সুতো পরিয়ে দিলে তাতে কারও কিছু আসে যায় না। কিন্তু শুধু তো সুতো নয়- এখন ওকে ঠেকাবে কোথায় ? কৃষ্ণদয়াল। বেশ । সব দোষ বুঝি আমার ! গোড়ায় তুমি যে ভুল করলে | তুমি যে ওকে কোনোমতেই ছাড়তে চাইলে না। তখন আমিও গোয়ারগোছের ছিলুম— ধর্মকর্ম কোনো-কিছুর তো জ্ঞান ছিল না। এখন হলে কি এমন কাজ করতে পারতুম | আনন্দময়ী । কিন্তু যাই বল, আমি যে কিছু অধৰ্ম করেছি। সে আমি কোনোমতে মানতে পারব না । তোমার তো মনে আছে ছেলে হবার জন্যে আমি কী না করেছি— যে যা বলেছে তাই শুনেছি- কত মাদুলি কত মন্তর নিয়েছি সে তো তুমি জােনই | একদিন স্বপ্নে দেখলুম যেন সাজি ভরে টগরফুল নিয়ে এসে ঠাকুরের পুজো করতে বসেছি— এক সময় চেয়ে দেখি সাজিতে ফুল নেই, ফুলের মতো ধবধবে একটি ছোট্ট ছেলে ; আহা, সে কী দেখেছিলাম সে কী বলব, আমার দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লািগল— তাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিতে যাব আর ঘুম ভেঙে গেল। তার দশ দিন না যেতেই তো গোরাকে পেলুম— সে আমার ঠাকুরের দান- সে কি আর-কারও যে আমি কাউকে ফিরিয়ে দেব। আর-জন্মে তাকে গর্ভে ধারণ করে বােধ হয় অনেক কষ্ট পেয়েছিলুম তাই আজ সে আমাকে মা বলতে এসেছে। কেমন করে কোথা থেকে সে এল ভেবে দেখো দেখি । চারি দিকে তখন মারামারি কাটাকাটি, নিজের প্রাণের ভয়েই মরি— সেই সময় রাত-দুপুরে সেই মেম যখন আমাদের বাড়িতে এসে লুকোল, তুমি তো তাকে ভয়ে বাড়িতে রাখতেই চাও না- আমি তোমাকে ভঁাড়িয়ে তাকে গোয়ালঘরে লুকিয়ে রাখলুম। সেই রাত্রেই ছেলেটি প্রসব করে সে তো মারা গেল। সেই বাপ-ম-মরা ছেলেকে আমি যদি না বীচাতুম তো সে কি বীচত ? তোমার কী ! তুমি তো পাদ্রির হাতে ওকে দিতে চেয়েছিলে । কেন ! পাদ্রিকে দিতে যাব কেন ! পাদ্রি কি ওর মা-বাপ, না। ওর প্রাণরক্ষা করেছে ? এমন । করে যে ছেলে পেয়েছি সে কি গর্ভে পাওয়ার চেয়ে কম। তুমি যাই বল, এ ছেলে যিনি আমাকে দিয়েছেন তিনি স্বয়ং যদি না নেন তবে প্ৰাণ গেলেও আর কাউকে নিতে দিচ্ছি নে । কৃষ্ণদয়াল। সে তো জানি। তা, তোমার গোরাকে নিয়ে তুমি থাকো, আমি তো কখনো তাতে কোনো বাধা দিইনি। কিন্তু ওকে ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে তার পরে ওর পাইতে না দিলে তো সমাজে মানবে না। তাই পইতে কাজেই দিতে হল। এখন কেবল দুটি কথা ভাববার আছে। ন্যায়ত আমার বিষয়সম্পত্তি সমস্ত মহিমেরই প্ৰাপ্য- তাই আনন্দময়ী। কে তােমার বিষয়সম্পত্তির অংশ নিতে চায়! তুমি যত টাকা করেছ সব তুমি মহিমকে দিয়ে যেয়ে- গোরা তার এক পয়সাও নেবে না। ও পুরুষমানুষ, লেখাপড়া শিখেছে, নিজে খেটে উপার্জন করে খাবে- ও পরের ধনে ভাগ বসাতে যাবে কেন! ও বেঁচে থাক সেই আমার ঢেরাআমার আর কোনো সম্পত্তির দরকার নেই। কৃষ্ণদয়াল। না, ওকে একেবারে বঞ্চিত করব না, জায়গিরটা ওকেই দিয়ে দেব- কালে তার