পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোর। V \9እsዓ মুনফগ বছরে হাজার টাকা হতে পারবে। এখন ভাবনার কথা হচ্ছে ওর বিবাহ দেওয়া নিয়ে। পূর্বে যা কবেছি তা করেছি- কিন্তু এখন তো হিন্দুমতে ব্ৰাহ্মণের ঘরে ওর বিয়ে দিতে পারব না— তা এতে তুমি রাগই কর আর যাই কর । আনন্দময়ী। হায় হায়, তুমি মনে কর তোমার মতো পৃথিবীময় গঙ্গাজল আর গোবর ছিটিয়ে বেড়াই নে বলে আমার ধর্মজ্ঞান নেই। ব্ৰাহ্মণের ঘরে ওর বিয়েই বা দেব কেন, আর রাগ করবই বা কী ளே ? কৃষ্ণদয়াল । বল কী ! তুমি যে বামুনের মেয়ে । আনন্দময়ী। তা হই না বামুনের মেয়ে । বামনাই করা তো আমি ছেড়েই দিয়েছি। ঐ তো মহিমের তফাত হয়ে ছিলুম, কথাটি কই নি। পৃথিবীসুদ্ধ লোক আমাকে খৃস্টান বলে, আরো কত কী কথা কয়- আমি সমস্ত মেনে নিয়েই বলি, তা খৃস্টােন কি মানুষ নয়! তোমরাই যদি এত উচু জাত আর ভগবানের এত আদরের তবে তিনি একবার পাঠানের, একবার মোগলের, একবার খৃস্টানের পায়ে এমন করে তোমাদের মাথা মুড়িয়ে দিচ্ছেন কেন ? কৃষ্ণদয়াল। ও-সব অনেক কথা, তুমি মেয়েমানুষ সে-সব বুঝবে না। কিন্তু সমাজ একটা আছে— সেটা তো বোঝ, সেটা তোমার মেনে চলাই উচিত । আনন্দময়ী | আমার বুঝে কাজ নেই । আমি এই বুঝি যে, গোরাকে আমি যখন ছেলে বলে মানুষ করেছি তখন আচার-বিচারের ভড়ং করতে গেলে সমাজ থাক আর না-থাক ধৰ্ম থাকবে না। আমি কেবল সেই ধর্মের ভয়েই কোনোদিন কিছু লকেই নে— আমি যে কিছু মানছি নে সে সকলকেই জানতে দিই, আর সকলেরই ঘূণা কুড়িয়ে চুপ করে পড়ে থাকি । কেবল একটি কথাই লুকিয়েছি, তারই জন্যে ভয়ে ভয়ে সারা হয়ে গেলুম, ঠাকুর কখন কী করেন ; দেখো, আমার মনে হয় গোরাকে সকল কথা বলে ফেলি, তার পরে অদূদ্ষ্টে যা থাকে তাই হবে । কৃষ্ণদয়াল ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “না না, আমি বেঁচে থাকতে কোনোমতেই সে হতে পারবে না। গোরাকে তো জােনই । এ কথা শুনলে সে কী যে করে বসবে তা কিছুই বলা যায় না । তার পরে সমাজে একটা হুলস্থূল পড়ে যাবে। শুধু তাই ? এ দিকে গবর্মেন্ট কী করে তাও বলা যায় না। যদিও গোরার বাপ লড়াইয়ে মারা গেছে, ওর মাও তো মরেছে জানি, কিন্তু সব হাঙ্গামা চুকে গেলে মাজেস্টরিতে খবর দেওয়া উচিত ছিল । এখন এই নিয়ে যদি একটা গোলমাল উঠে পড়ে তা হলে আমার সাধন-ভজন সমস্ত মাটি হবে, আরো কী বিপদ ঘটে বলা যায় না ।” আনন্দময়ী নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিলেন । কৃষ্ণদয়াল কিছুক্ষণ পরে কহিলেন, “গোরার বিবাহ সম্বন্ধে আমি একটা পরামর্শ মনে মনে করেছি। পরেশ ভট্টচাজ আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ত। সে স্কুল-ইনসাপেক্টরি কাজে পেনসন নিয়ে সম্প্রতি কলকাতায় এসে বসেছে। সে ঘোর ব্রাহ্মা ! শুনেছি তীর ঘরে অনেকগুলি মেয়েও আছে। গোরাকে তার বাড়িতে যদি ভিড়িয়ে দেওয়া যায়। তবে যাতায়াত প্রশ্ন করতে পারশের কােনাে মেযেকে তার পছন্দ হয়ে যেতেও পারে। তার পরে প্রজাপতির יין আনন্দময়ী। বল কী ! গােরা ব্ৰাহ্মর বাড়ি যাতায়াত করবে ? সেদিন ওর আর নেই। বলিতে বলিতে স্বয়ং গোরা তাহার মেঘমন্দ্র স্বরে “মা” বলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কৃষ্ণদয়ালকে এখানে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে কিছু আশ্চর্য হইয়া গেল। আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি উঠিয়া গােরার কাছে গিয়া দুই চক্ষে স্নেহ বিকীর্ণ করিতে করিতে কহিলেন, “কী বাবা, কী চাই ?” "নী বিশেষ কিছু না, এখন থাক।” বলিয়া গোরা ফিরিবার উপক্ৰম করিল। কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “একটু বোসো, একটা কথা আছে। আমার একটি ব্ৰাহ্মবন্ধু সম্প্রতি কলকাতায় এসেছেন ; তিনি হেদোতলায় থাকেন।” গোরা। পরেশবাবু নাকি ?