পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা \OS) গেছে। ও এত বকে যে, ওর দিদি ওকে ব্যক্তিয়ার খিলজি নাম দিয়েছে।” বিনয় কহিল, “আমিও খুব বকতে পারি। তাই আমাদের দুজনের খুব ভাব হয়ে গেছে। কী বল সতীশবাবু!” সতীশ এ কথার কোনাে উত্তর দিল না ; কিন্তু পাছে তাহার নূতন নামকরণ লইয়া বিনয়ের কাছে তাহার গৌরবহানি হয় সেইজন্য সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। এবং কহিল, “বেশ তো, ভালোই তো । ব্যক্তিয়ার খিলজি ভালোই তো। আচ্ছা বিনয়বাবু, বক্তিয়ার খিলজি তো লড়াই করেছিল ? সে তো বাংলা দেশ জিতে নিয়েছিল ?” বিনয় হাসিয়া কহিল, “আগে সে লড়াই করত, এখন আর লড়াইয়ের দরকার হয় না, এখন সে শুধু বক্তৃতা করে। আর স্বাংলা দেশ জিতেও নেয়।” এমনি করিয়া অনেকক্ষণ কথাবার্তা হইল। পরেশ সকলের চেয়ে কম কথা কহিয়াছিলেন- তিনি কেবল প্রসন্ন শান্ত মুখে মাঝে মাঝে হাসিয়া”, এবং দুটা-একটা কথায় যোগ দিয়াছেন। বিদায় ডান-হাতি গিয়ে-” সতীশ কহিল, “উনি আমাদের বাড়ি জানেন । উনি যে সেদিন আমার সঙ্গে বরাবর আমাদের দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলেন ।” এ কথায় লজ্জা পাইবার কোনোই প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু বিনয় মনে মনে লজ্জিত হইয়া উঠিল । যেন কী-একটা তাহার ধরা পড়িয়া গেল । বৃদ্ধ কহিলেন, “তবে তো আপনি আমাদের বাড়ি জানেন। তা হলে যদি কখনাে আপনার—” বিনয় । সে আর বলতে হবে না । যখনইপরেশ । আমাদের এ তো একই পাড়া- কেবল কলকাতা বলেই এতদিন চেনা-শোনা হয় নি । বিনয় রাস্তা পর্যন্ত পারেশকে পৌঁছাইয়া দিল। দ্বারের কাছে কিছুক্ষণ সে দাড়াইয়া রহিল। পরেশ লাঠি লইয়া ধীরে ধীরে চলিলেন- আর সতীশ ক্রমাগত বকিতে বকিতে তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল । বিনয় মনে মনে বলিতে লাগিল, পরেশবাবুর মতো এমন বৃদ্ধ দেখি নাই, পায়ের ধূলা লইতে ইচ্ছা! করে। আর সতীশ ছেলেটি কী চমৎকার! বাচিয়া থাকিলে এ একজন মানুষ হইবে- যেমন বুদ্ধি তেমনি সরলতা । এই বৃদ্ধ এবং বালকটি যতই ভালো হােক এত অল্পক্ষণের পরিচয়ে তাহাদের সম্বন্ধে এতটা পরিমাণে ভক্তি ও স্নেহের উচ্ছাস সাধারণত সম্ভবপর হইতে পারিত না । কিন্তু বিনয়ের মনটা এমন অবস্থায় ছিল যে, সে অধিক পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে নাই । তাহার পরে বিনয় মনে মনে ভাবিতে লাগিল— পরেশবাবুর বাড়িতে যাইতেই হইবে, নহিলে ভদ্রতা রক্ষা হইবে না । কিন্তু গোরার মুখ দিয়া তাহাদের দলের ভারতবর্ষ তাহাকে বলিতে লাগিল, ওখানে তোমার যাতায়াত চলিবে না । খবরদার ! বিনয় পদে পদে তাহদের দলের ভারতবর্ষের অনেক নিষেধ মানিয়াছে। অনেক সময় বিধা বোধ করিয়াছে, তবু মানিয়াছে। আজ তাহার মনের ভিতরে একটা বিদ্রোহ দেখা দিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, ভারতবর্ষ যেন কেবল নিষেধেরই মূর্তি। চাকর আসিয়া খবর দিল আহার প্রস্তুত— কিন্তু এখনাে বিনয়ের স্নানও হয় নাই। বারোটা বাজিয়া গৈছে। হঠাৎ এক সময়ে বিনয় সজোরে মাথা ঝাড়া দিয়া কহিল, “আমি খাব না, তোরা যা ।” বলিয়া ছাতা ঘাড়ে করিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল- একটা চাদরও কঁধে লইল না। বরাবর গোরাদের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। বিনয় জানিত আমহাস্ট স্ত্রীটে একটা বাড়ি ভাড়া লীইয়া হিন্দুহিতৈষীর আপিস বসিয়াছে ; প্রতিদিন মধ্যাহ্নে গোরা আপিসে গিয়া সমস্ত বাংলা দেশে তীহার দলের লোক যেখানে যে আছে সবাইকে পত্র লিখিয়া জাগ্ৰত করিয়া রাখে। এইখনেই তাহার