পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 OO রবীন্দ্র-রচনাবলী ভক্তরা তাহার মুখে উপদেশ শুনিতে আসে এবং তাহার সহকারিতা করিয়া নিজেকে ধন্য মনে করে। সেদিনও গােরা সেই আপিসের কাজে গিয়াছিল। বিনয় একেবারে যেন দৌড়িয়া অন্তঃপুরে আনন্দময়ীর ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তখন ভাত খাইতে বসিয়াছিলেন এবং লছমিয়া তাহার কাছে বসিয়া তাহাকে পাখা করিতেছিল । আনন্দময়ী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কী রে বিনয়, কী হয়েছে তোর ?” বিনয় তাহার সম্মুখে বসিয়া পড়িয়া কহিল, “মা, বড়ো খিদে পেয়েছে, আমাকে খেতে দাও।” আনন্দময়ী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “তবেই তো মুশকিলে ফেললি । বামুন-ঠাকুর চলে গেছে-- তোরা যে আবার-” বিনয় কহিল, “আমি কি বামুন-ঠাকুরের রান্না খেতে এলুম। তা হলে আমার বাসার বামুন কী দোষ করলে ? আমি তোমার পাতের প্রসাদ খাব মা ।। লছমিয়া, দে তো আমাকে এক গ্লাস জল এনে ৷” লছমিয়া জল আনিয়া দিতেই বিনয় ঢাক ঢকা করিয়া খাইয়া ফেলিল। তখন আনন্দময়ী আর-একটা থালা আনাইয়া নিজের পাতের ভাত সস্নেহে সযত্নে মাখিয়া সেই থালে তুলিয়া দিতে থাকিলেন এবং বিনয় বহুদিনের বুভূক্ষুর মতো তাঁহাই খাইতে লাগিল । আনন্দময়ীর মনের একটা বেদনা আজ দূর হইল। তাহার মুখে প্ৰসন্নতা দেখিয়া বিনয়েরও বুকের একটা বোঝা যেন নামিয়া গেল । আনন্দময়ী বালিশের খোল সেলাই করিতে বসিয়া গেলেন ; কেয়াখয়ের তৈরি করিবার জন্য পাশের ঘরে কেয়াফুল জড়ো হইয়াছিল তাঁহারই গন্ধ আসিতে লাগিল ; বিনয় আনন্দময়ীর পায়ের কাছে উন্ধের্বাখিত একটা হাতে মাথা রাখিয়া আধ-শোয়া রকমে পড়িয়া রহিল এবং পৃথিবীর আর সমস্ত ভুলিয়া ঠিক সেই আগেকার দিনের মতো আনন্দে বকিয়া যাইতে লাগিল । br এই একটা বঁধ ভাঙিয়া যাইতেই বিনয়ের হৃদয়ের নূতন বন্যা আরো যেন উদ্দাম হইয়া উঠিল । আনন্দময়ীর ঘর হইতে বাহির হইয়া রাস্তা দিয়া সে যেন একেবারে উড়িয়া চলিল ; মাটির স্পর্শ তাহার যেন পায়ে ঠেকিল না ; তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল মনের যে কথাটা লইয়া সে এ-কয়দিন সংকোচে পীড়িত হইয়াছে তাহাই আজ মুখ তুলিয়া সকলের কাছে ঘোষণা করিয়া দেয় । বিনয় যে মুহুর্তে ৭৮ নম্বরের দরজার কাছে আসিয়া পৌছিল ঠিক সেই সময়েই পরেশও বিপরীত দিক দিয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । বসিবার ঘরটাতে লইয়া গিয়া বসাইলেন । একটি ছোটাে টেবিল, তাহার এক ধারে পিঠওয়ালা বেঞ্চি, অন্য ধারে একটা কাঠের ও বেতের চৌকি ; দেয়ালে এক দিকে যিশু খৃস্টের একটি রঙ-করা ছবি এবং অন্য দিকে কেশববাবুর ফোটােগ্রাফ। টেবিলের উপর দুই-চারি দিনের খবরের কাগজ ভঁাজ করা, তাহার উপরে সীসার কাগজ-চাপা । কোণে একটি ছোটাে আলমারি, তাহার উপরের থাকে থিয়োডোর পার্কারের বই সারি সারি সাজানো রহিয়াছে দেখা যাইতেছে । আলমারির মাথার উপরে একটি গ্লোব কাপড় দিয়া ঢাকা রহিয়াছে। বিনয় বসিল ; তাহার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল ; মনে হইতে লাগিল তাহার পিঠের দিকের খোলা দরজা দিয়া যদি কেহ ঘরের ভিতরে আসিয়া প্ৰবেশ করে । পরেশ কহিলেন, “সোমবারে সুচরিতা আমার একটি বন্ধুর মেয়েকে পড়াতে যায়, সেখানে সতীশের একটি সমবয়সী ছেলে আছে তাই সতীশও তার সঙ্গে গেছে । আমি তাদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছি। আর একটু দেরি হলেই তো আপনার সঙ্গে দেখা হত না ।” খবরটা শুনিয়া বিনয় একই কালে একটা আশাভঙ্গের খোচা এবং আরাম মনের মধ্যে অনুভব করিল। পরেশের সঙ্গে তাহার কথাবার্তা দিব্য সহজ হইয়া আসিল ।