পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(53 8 Ο\O করিয়া বলিতে বাধিল ; ইহা কি তাহার ভীরুতা, অথবা জাতিভেদ মানি বলিলে কথাটা যতদূর পীেছে আজ তাহার মন ততদূর পর্যন্ত যাইতে স্বীকার করিল না, তাহা নিশ্চয় বলা যায় না। পরেশ পাছে তর্কটা বেশিদূর যায় বলিয়া এইখানেই বাধা দিয়া কহিলেন, “রাধে, তোমার মাকে এবং সকলকে ডেকে আনো- এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই ।” সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেই সতীশ তাহার সঙ্গে বকিতে বকিতে লাফাইতে লাফাইতে চলিয়া গেল । কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, “বাবা, মা তোমাদের উপরের বারান্দায় আসতে বললেন ।” উপরে গাড়িবারান্দায় একটা টেবিলে শুভ্ৰ কাপড় পাতা, টেবিল ঘেরিয়া চৌকি সাজানো । রেলিঙের বাহিরে কার্নিসের উপরে ছোটাে ছোটাে টবে পাতাবাহার এবং ফুলের গাছ। বারান্দার উপর হইতে রাস্তার ধারের শিরীষ ও কৃষ্ণচূড়া গাছের বর্ষা-জলধীেত পল্লবিত চিকুণতা দেখা যাইতেছে। সূর্য তখনো অন্ত যায় নাই ; পশ্চিম আকাশ হইতে স্নান রৌদ্র সোজা হইয়া বারান্দার এক প্রান্তে আসিয়া পড়িয়াছে। ছাতে তখন কেহ ছিল না। একটু পরেই সতীশ সাদাকালো-রোয়াওয়ালা এক ছোটাে কুকুর সঙ্গে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নাম খুদে । এই কুকুরের যতরকম বিদ্যা ছিল সতীশ তাহা বিনয়কে দেখাইয়া দিল। সে এক পা তুলিয়া সেলাম করিল, মাথা মাটিতে ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিল, একখণ্ড বিস্কুট দেখাইতেই লেজের উপর বসিয়া দুই পা জড়ো করিয়া ভিক্ষা চাহিল। এইরূপে খুদে যে খ্যাতি অর্জন করিল। সতীশই তাহা আত্মসাৎ করিয়া গর্ব অনুভব করিল— এই যশোলাভে খুদের লেশমাত্র উৎসাহ ছিল না, বস্তুত যশোর চেয়ে বিস্কুটটাকে সে ঢের বেশি সত্য বলিয়া গণ্য করিয়াছিল। কোনাে একটা ঘর হইতে মাঝে মাঝে মেয়েদের গলার খিলখিল হাসি ও কৌতুকের কণ্ঠস্বর এবং তাহার সঙ্গে একজন পুরুষের গলাও শুনা যাইতেছিল। এই অপৰ্যাপ্ত হাস্যকীেতুকের শব্দে বিনয়ের মনের মধ্যে একটা অপূর্ব মিষ্টতার সঙ্গে সঙ্গে একটা যেন ঈর্ষার বেদনা বহন করিয়া আনিল। ঘরের ভিতরে মেয়েদের গলার এই আনন্দের কলধ্বনি বয়স হওয়া অবধি সে এমন করিয়া কখনো শুনে নাই। এই আনন্দের মাধুর্য তাহার এত কাছে উচ্ছসিত হইতেছে অথচ সে ইহা হইতে এত দূরে। সতীশ তাহার কানের কাছে কী বলিতেছিল, বিনয় তাহা মন দিয়া শুনিতেই পারিল না । পরেশবাবুর স্ত্রী তাহার তিন মেয়েকে সঙ্গে করিয়া ছাতে আসিলেন- সঙ্গে একজন যুবক আসিল, সে ঠাহাদের দূর আত্মীয়। পরেশবাবুর স্ত্রীর নাম বরদাসুন্দরী। র্তাহার বয়স অল্প নহে। কিন্তু দেখিলেই বোঝা যায় যে বিশেষ যত্ন করিয়া সাজ করিয়া আসিয়াছেন। বড়োবয়স পর্যন্ত পাড়া গেয়ে মেয়ের মতো কাটাইয়া হঠাৎ এক সময় হইতে আধুনিক কালের সঙ্গে সমান বেগে চলিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন ; সেইজন্যই - র্তাহার সিস্কের শাড়ি বেশি খসখস এবং উচু গোড়ালির জুতা বেশি খটখট শব্দ করে। পৃথিবীতে কোন জিনিসটা ব্ৰাহ্ম এবং কোনটা অব্রাহ্ম তাঁহারই ভেদ লইয়া তিনি সর্বদাই অত্যন্ত সতর্ক হইয়া থাকেন। সেইজন্যই রাধারানীর নাম পরিবর্তন করিয়া তিনি সুচরিতা রাখিয়াছেন। কোনাে-এক সম্পর্কে তঁহার এক শ্বশুর বহুদিন পরে বিদেশের কর্মস্থান হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাহাদিগকে জামাইষষ্ঠী পঠাইয়াছিলেন। পরেশবাবু তখন কর্ম উপলক্ষে অনুপস্থিত ছিলেন। বরদাসুন্দরী এই জামাইষষ্ঠীর উপহার সমস্ত ফেরত পঠাইয়াছিলেন। তিনি এ-সকল ব্যাপারকে কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার অঙ্গ বলিয়া জ্ঞান করেন। মেয়েদের পায়ে মোজা দেওয়াকে এবং টুপি পরিয়া বাহিরে যাওয়াকে তিনি এমনভাবে দেখেন যেন তাহাও ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমতের একটা অঙ্গ। কোনো ব্ৰাহ্ম-পরিবারে মাটিতে আসন পাতিয়া খাইতে দেখিয়া তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, আজকাল ব্ৰাহ্মসমাজ