পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8Oዓ বিনয় মনে মনে ইহা বুঝিতে পারিল, গোরার আজিকার এই-যে সাজ ইহা যুদ্ধসােজ। গোরা কী জানি কী করিয়া বসে এই ভাবিয়া বিনয়ের মনে একটা ভয়, একটা সংকোচ এবং একটা বিরোধের ভাব জাগিয়া উঠিল । । বরদাসুন্দরী যখন বিনয়ের সঙ্গে আলাপ করিতেছিলেন তখন সতীশ অগত্যা ছাতের এক কোণে একটা টিনের লাটিম ঘুরাইয়া নিজের চিত্তবিনােদনে নিযুক্ত ছিল। গোরাকে দেখিয়া তাহার লাটিম ঘোরানাে বন্ধ হইয়া গেল ; সে ধীরে ধীরে বিনয়ের পাশে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি গোরাকে দেখিতে লাগিল এবং কানে কানে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “ইনিই কি আপনার বন্ধু ?” বিনয় কহিল, “হঁ৷ ” গোরা ছাতে আসিয়া মুহুর্তের এক-অংশ-কাল বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া আর যেন তাহাকে দেখিতেই পাইল না। পরেশকে নমস্কার করিয়া সে অসংকোচে একটা চৌকি টেবিল হইতে কিছু দূরে সরাইয়া লইয়া বসিল । মেয়েরা যে এখানে কোনো-এক জায়গায় আছে তাহা লক্ষ্য করা সে অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল। বরদাসুন্দরী এই অসভোর নিকট হইতে মেয়েদিগকে লইয়া চলিয়া যাইবেন স্থির করিতেছিলেন এমন সময় পরেশ তীহাকে কহিলেন, “এর নাম গৌরমোহন, আমার বন্ধু কৃষ্ণদয়ালের ছেলে।” তখন গোরা তাহার দিকে ফিরিয়া নমস্কার করিল। যদিও বিনয়ের সঙ্গে আলোচনায় সুচরিতা গােরার কথা পূর্বেই শুনিয়াছিল, তবু এই অভ্যািগতািটই যে বিনয়ের বন্ধু তাহা সে বুঝে নাই। প্রথম দৃষ্টিতেই গোরার প্রতি তাহার - এটা আক্রোশ জন্মিল। ইংরেজি-শেখা কোনো লোকের মধ্যে গোড়া হিন্দুয়ানি দেখিলে সহ্য করিতে পারে সুচরিতার সেরূপ সংস্কার ও সহিষ্ণুতা ছিল না। পরেশ গােরার কাছে তাহার বাল্যবন্ধু কৃষ্ণদয়ালের খবর লইলেন। তাহার পরে নিজেদের ছাত্র-অবস্থার কথা আলোচনা করিয়া বলিলেন, “তখনকার দিনে কলেজে। আমরা দুজনেই একজুড়ি ছিলুম- দুজনেই মস্ত কালাপাহাড়— কিছুই মানতুম না— হােটেলে খাওয়াটাই একটা কর্তব্যকর্ম বলে মনে করতুম | দুজনে কতদিন সন্ধার সময় গোলদিঘিতে বসে মুসলমান দোকানের কাবাব খেয়ে তার পরে কী রকম করে আমরা হিন্দুসমাজের সংস্কার করব রাত দুপুর পর্যন্ত তারই আলোচনা করতুম ||” গোরা কহিল, “এখন তিনি হিন্দু-আচার পালন করেন ।” বরদা কহিলেন, “লজ্জা করে না ?”— রাগে তােহর সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছিল । গোরা একটু হাসিয়া কহিল, “লজ্জা করাটা দুর্বল ঋ৬৷<র লক্ষণ। কেউ কেউ বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা করে ।” বরদা । আগে তিনি ব্ৰাহ্ম ছিলেন না ? ? গোরা। আমিও তো এক সময়ে ব্রাহ্ম ছিলুম। বরদা | এখন আপনি সাকার-উপাসনায় বিশ্বাস করেন ? গোরা । আকার জিনিসটাকে বিনা কারণে অশ্রদ্ধা করব আমার মনে এমন কুসংস্কার নেই। আকারকে গাল দিলেই কি সে ছোটো হয়ে যায় ? আকারের রহস্য কে ভেদ করতে পেরেছে ? পরেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “আকার যে অন্তবিশিষ্ট।” গোরা কহিল, “অন্ত না থাকলে যে প্রকাশই হয় না । অনন্ত আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই অন্তকে আশ্রয় করেছেন- নইলে তার প্রকাশ কোথায় ? যার প্রকাশ নেই তার সম্পূর্ণতা নেই। বাক্যের মধ্যে যেমন ভােব তেমনি আকারের মধ্যে নিরাকার পরিপূর্ণ।” বরদা মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “নিরাকারের চেয়ে আকার সম্পূৰ্ণ আপনি এমন কথা বলেন ?” গোরা। আমি যদি নাও বলতুম তাতে কিছুই আসত যেত না । জগতে আকার আমার বলার উপর নির্ভর করছে না। নিরাকারই যদি যথার্থ পরিপূর্ণত হত। তবে আকার কোথাও স্থান পেত না।