পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী "לפ8 (गोद्धा । उस ? বিনয় । না খাওয়াটা তার চেয়ে বেশি কড়া লাগত। গোরা । সমাজপালনটা তা হলে কি কেবলমাত্র ভদ্রতাপালন ? বিনয় । সব সময়ে নয়। কিন্তু দেখো গোরা, সমাজের সঙ্গে যেখানে হৃদয়ের সংঘাত বাধে সেখানে আমার পক্ষে গোরা অধীর হইয়া উঠিয়া বিনয়কে কথাটা শেষ করিতেই দিল না। সে গৰ্জিয়া কহিল, “হৃদয়। সমাজকে তুমি ছােটাে করে তুচ্ছ করে দেখ বলেই কথায় কথায় তোমার হৃদয়ের সংঘাত বাধে। কিন্তু সমাজকে আঘাত করলে তার বেদনা যে কতদূর পর্যন্ত গিয়ে পীেছয় তা যদি অনুভব করতে তা হলে তোমার ঐ হৃদয়টার কথা তুলতে তোমার লজ্জা বোধ হত। পরেশবাবুর মেয়েদের মনে একটুখানি আঘাত দিতে তোমার ভারি কষ্ট লাগে- কিন্তু আমার কষ্ট লাগে এতটুকুর জন্য সমস্ত দেশকে যখন অনায়াসে আঘাত করতে পার ।” বিনয় কহিল, “তবে সত্য কথা বলি ভাই গোরা। এক পেয়ালাচা খেলে সমস্ত দেশকে যদি আঘাত করা হয় তবে সে আঘাতে দেশের উপকার হবে। তার থেকে বঁচিয়ে চললে দেশটাকে অত্যন্ত দুর্বল, বাবু করে তোলা হবে।” গোরা। ওগো মশায়, ও-সমস্ত যুক্তি আমি জানি- আমি যে একেবারে অবুঝ তা মনে কোরো না। কিন্তু এ-সমস্ত এখনকার কথা নয়। রুগি ছেলে যখন ওষুধ খেতে চায় না, মা তখন সুস্থ শরীরেও নিজে ওষুধ খেয়ে তাকে জানাতে চায় যে, তোমার সঙ্গে আমার এক দশা- এটা তো যুক্তির কথা নয়, এটা ভালোবাসার কথা। এই ভালোবাসা না থাকলে যতই যুক্তি থােক-না ছেলের সঙ্গে মায়ের যোগ নষ্ট হয় । তা হলে কাজও নষ্ট হয় । আমিও চায়ের পেয়ালা নিয়ে তর্ক করি না- কিন্তু দেশের সঙ্গে বিচ্ছেদ আমি সহ্য করতে পারি না- চা না খাওয়া তার চেয়ে ঢের সহজ, পরেশবাবুর মেয়ের মনে কষ্ট দেওয়া তার চেয়ে ঢের ছোটো । সমস্ত দেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেলাই আমাদের এখনকার অবস্থায় সকলের চেয়ে প্রধান কাজ— যখন মিলন হয়ে যাবে তখন চা খাবে কি না-খাবে দু কথায় সে তর্কের মীমাংসা হয়ে যাবে। বিনয় । তা হলে আমার দ্বিতীয় পেয়ালা চা খাবার অনেক বিলম্ব আছে দেখছি । গোরা। না, বেশি বিলম্ব করবার দরকার নেই। কিন্তু, বিনয়, আমাকে আর কেন ? হিন্দুসমাজের অনেক অপ্রিয় জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও ছাড়বার সময় এসেছে। নইলে পরেশবাবুর মেয়েদের মনে আঘাত লাগবে । এমন সময় অবিনাশ ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। সে গোরার শিষ্য। গোরার মুখ হইতে সে যাহা শোনে তাঁহাই সে নিজের বুদ্ধি-দ্বারা ছােটাে এবং নিজের ভাষার দ্বারা বিকৃত করিয়া চারিদিকে বলিয়া বেড়ায় । গোরার কথা যাহারা কিছুই বুঝিতে পারে না, অবিনাশের কথা তাহারা বেশ বোঝে ও প্রশংসা করে । বিনয়ের প্রতি অবিনাশের অত্যন্ত একটা ঈর্ষার ভাব আছে। তাই সে জো পাইলেই বিনয়ের সঙ্গে নির্বোধের মতো তর্ক করিতে চেষ্টা করে। বিনয় তাহার মুঢ়তায় অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠে- তখন গােরা অবিনাশের তর্ক নিজে তুলিয়া লইয়া বিনয়ের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। অবিনাশ মনে করে তাহারই যুক্তি যেন গোরার মুখ দিয়া বাহির হইতেছে। অবিনাশ আসিয়া পড়াতে গোরার সঙ্গে মিলন-ব্যাপারে বিনয় বাধা পাইল । সে তখন উঠিয়া উপরে গেল। আনন্দময়ী তাহার ভাড়ার-ঘরের সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া তরকারি কুটিতেছিলেন। আনন্দময়ী কহিলেন, “অনেকক্ষণ থেকে তোমাদের গলা শুনতে পাচ্ছি। এত সকালে যে ? জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছ তো ?” অন্য দিন হইলে বিনয় বলিত, না, খাই নাই— এবং আনন্দময়ীর সম্মুখে বসিয়া তাহার আহার জমিয়া উঠিত। কিন্তু আজ বলিল, “না মা, খাব না- খেয়েই বেরিয়েছি।”