পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 RR রবীন্দ্র-রচনাবলী লাইবার জন্য তাঁহাদের পশ্চাতে ছুটিল। কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “মা আপনাকে একটু বসতে বললেন, এখনই তিনি আসছেন। বাবা অনাথবাবুদের বাড়ি গেছেন, তারও আসতে দেরি হবে না।” সুচরিতা বিনয়ের সংকোচ ভাঙিয়া দিবার জন্য গোরার কথা তুলিল। হাসিয়া কহিল, “তিনি বোধ হয়। আমাদের এখানে আর কখনো আসবেন না ?” বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ?” সুচরিতা কহিল, “আমরা পুরুষদের সামনে বেরোই দেখে তিনি নিশ্চয় অবাক হয়ে গেছেন। ঘরকরনার মধ্যে ছাড়া মেয়েদের আর কোথাও দেখলে তিনি বোধ হয় তাদের শ্রদ্ধা করতে পারেন का |” বিনয় ইহার উত্তর দিতে কিছু মুশকিলে পড়িয়া গেল। কথাটার প্রতিবাদ করিতে পারিলেই সে খুশি হইত, কিন্তু মিথ্যা বলিবে কী করিয়া ? বিনয় কহিল, “গোরার মত এই যে, ঘরের কাজেই মেয়েরা সম্পূর্ণ মন না দিলে তাদের কর্তব্যের একাগ্ৰতা নষ্ট হয়।” সুচরিতা কহিল, “তা হলে মেয়েপুরুষে মিলে ঘরবাহিরকে একেবারে ভাগ করে নিলেই তো ভালো হত । পুরুষকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় বলে তাদের বাইরের কর্তব্য হয়তো ভালো করে সম্পন্ন হয় না। আপনিও আপনার বন্ধুর মতে মত দেন না কি ?” নারীনীতি সম্বন্ধে এ-পর্যন্ত তো বিনয় গোরার মতেই মত দিয়া আসিয়াছিল । ইহা লইয়া সে কাগজে লেখালেখিও করিয়াছে। কিন্তু সেইটেই যে বিনয়ের মত, এখন তাহা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না। সে কহিল, “দেখুন,আসলে এ-সকল বিষয়ে আমরা অভ্যাসের দাস । সেইজন্যেই মেয়েদের বাইরে বেরোতে দেখলে মনে খটকা লাগে- অন্যায় বা অকর্তব্য বলে যে খারাপ লাগে সেটা কেবল আমরা জোর করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করি। যুক্তিটা এ স্থলে উপলক্ষ মাত্র, সংস্কারটাই আসল ।” সুচরিতা কহিল, “আপনার বন্ধুর মনে বোধ হয় সংস্কারগুলো খুব দৃঢ় ।” বিনয় । বাইরে থেকে দেখে হঠাৎ তাই মনে হয় । কিন্তু একটা কথা। আপনি মনে রাখবেন আমাদের দেশের সংস্কারগুলিকে তিনি যে চেপে ধরে থাকেন, তার কারণ এ নয় যে সেই সংস্কারগুলিকেই তিনি শ্ৰেয় মনে করেন । আমরা দেশের প্রতি অন্ধ অশ্রদ্ধাবশত দেশের সমস্ত প্ৰথাকে অবজ্ঞা করতে বসেছিলুম বলেই তিনি এই প্ৰলয়কার্যে বাধা দিতে দাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, আগে আমাদের দেশকে শ্রদ্ধার দ্বারা, প্রীতির দ্বারা সমগ্রভাবে পেতে হবে, জানতে হবে, তার পরে আপনিই ভিতর থেকে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের নিয়মে সংশোধনের কাজ চলবে । সুচরিতা কহিল, “আপনিই যদি হত তা হলে এতদিন হয় নি কেন ?” বিনয় । হয় নি তার কারণ, ইতিপূর্বে দেশ বলে আমাদের সমস্ত দেশকে, জাতি বলে আমাদের সমস্ত জাতিকে এক করে দেখতে পারি নি। তখন যদি বা আমাদের স্বজাতিকে অশ্রদ্ধা করিনি তেমনি শ্রদ্ধাও করি নি- অর্থাৎ তাকে লক্ষ্যই করা যায় নি- সেইজন্যেই তার শক্তি জাগে নি । এক সময়ে রোগীর দিকে না তাকিয়ে তাকে বিনা চিকিৎসায় বিনা পথ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল— এখন তাকে ডাক্তারখানায় আনা হয়েছে বটে, কিন্তু ডাক্তার তাকে এতই অশ্রদ্ধা করে যে, একে একে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনাে দীর্ঘ শুশ্রুষাসাধ্য চিকিৎসা সম্বন্ধে সে ধৈর্য ধরে বিচার করে না। এই সময়ে আমার বন্ধু ডাক্তারটি বলছেন, আমার এই পরমাত্মীয়টিকে যে চিকিৎসার চোটে আগাগোড়া নিঃশেষ করে ফেলবে এ আমি সহ্য করতে পারব না। এখন আমি এই ছেদনকার্য একেবারেই বন্ধ করে দেব এবং অনুকূল পথ্য-দ্বারা আগে এর নিজের ভিতরকার জীবনীশক্তিকে জাগিয়ে তুলব, তার পরে ছেদন করলেও রোগী সইতে পারবে, ছেদন না করলেও হয়তো রোগী সেরে উঠবে। গোরা বলেন, গভীর শ্রদ্ধাই আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় সকলের চেয়ে বড়ো পথ্যএই শ্রদ্ধার অভাবেই আমরা দেশকে সমগ্রভাবে জানতে পারছি নে- জানতে পারছি নে বলেই তার