পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२७ রবীন্দ্র-রচনাবলী গিয়া দেখিল বিনয় বরদাসুন্দরীর অনুসরণ করিয়া ঠাঁহাদের গাড়িতে উঠিতেছে- সমস্ত রাস্তার মাঝখানে নির্লজের মতাে অন্য পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে এক গাড়িতে গিয়া বসিতেছে! মূঢ় । নাগপাশে এমনি করিয়াই ধরা দিতে হয় ! এত সত্বর ! এত সহজে !! তবে বন্ধুত্বের আর ভদ্ৰন্থতা নাই। গোরা ঝড়ের মতোই ছুটিয়া চলিয়া গেল— আর গাড়ির অন্ধকারের মধ্যে বিনয় রাস্তার দিকে তাকাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বরদাসুন্দরী মনে করিলেন আচার্যের উপদেশ তাহার মনের মধ্যে কাজ করিতেছে- তিনি তাই কোনো কথা বলিলেন না । S (ቮ রাত্রে গোরা বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া অন্ধকার ছাতের উপর বেড়াইতে লাগিল । তাহার নিজের উপর রাগ হইল। রবিবারটা কেন সে এমন বৃথা কাটিতে দিল। ব্যক্তিবিশেষের প্ৰণয় লইয়া অন্য সমস্ত কাজ নষ্ট করিবার জন্য তো গোরা পৃথিবীতে আসে নাই। বিনয় যে পথে যাইতেছে সে পথ হইতে তাহাকে টানিয়া রাখিবার চেষ্টা করিলে কেবলই সময় নষ্ট এবং নিজের মনকে পীড়িত করা হইবে। অতএব জীবনের যাত্রাপথে এখন হইতে বিনয়কে বাদ দিতে হইবে। জীবনে গোরার একটিমাত্র বন্ধু আছে তাহাকেই ত্যাগ করিয়া গোরা তাহার ধর্মকে সত্য করিয়া তুলিবে। এই F জোর করিয়া হাত নাড়িয়া বিনয়ের সংস্রবকে নিজের চারি দিক হইতে যেন সরাইয়া এমন সময় মহিম ছাতে আসিয়া হাঁপাইতে লাগিলেন- কহিলেন, “মানুষের যখন ডানা নেই তখন এই তেতলা বাড়ি তৈরি করা কেন ? ডাঙার মানুষ হয়ে আকাশে বাস করবার চেষ্টা করলে আকাশবিহারী দেবতার সয় না। বিনয়ের কাছে গিয়েছিলে ?” গোরা তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “বিনয়ের সঙ্গে শশিমুখীর বিয়ে হতে পারবে না।” মহিম । কেন, বিনয়ের মত নেই নাকি ? ? গোরা । আমার মত নেই। মহিম হাত উলটাইয়া কহিলেন, “বেশ ! এ আবার একটা নতুন ফ্যাসাদ দেখছি। তোমার মত নেই। কারণটা কী শুনি ।” গোরা। আমি বেশ বুঝেছি বিনয়কে আমাদের সমাজে ধরে রাখা শক্ত হবে। ওর সঙ্গে আমাদের ঘরের মেয়ের বিবাহ চলবে না । মহিম। ঢের ঢের হিন্দুয়ানি দেখেছি, কিন্তু এমনটি আর কোথাও দেখলুম না। কাশী-ভাটপাড়া ছাড়িয়ে গেলো! তুমি যে দেখি ভবিষ্যৎ দেখে বিধান দাও। কোন দিন বলবে, স্বপ্নে দেখলুম খৃস্টান হয়েছ, গোবর খেয়ে জাতে উঠতে হবে। অনেক বকবকির পর মহিম কহিলেন, “মেয়েকে তো মূর্ধর হাতে দিতে পারি নে। যে ছেলে লেখাপড়া শিখেছে, যার বুদ্ধিাশুদ্ধি আছে, সে ছেলে মাঝে মাঝে শাস্ত্ৰ ডিঙিয়ে চলবেই। সেজন্যে তার সঙ্গে তর্ক করে, তাকে গাল দাও- কিন্তু তার বিয়ে বন্ধ করে মাঝে থেকে আমার মেয়েটাকে শক্তি দাও কেন ! তোমাদের সমস্তই উলটো বিচার ।” মহিম নীচে আসিয়া আনন্দময়ীকে কহিলেন, “মা, তোমার গোরাকে তুমি ঠেকও।” আনন্দময়ী উদবিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হয়েছে ?” মহিম। শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ আমি একরকম পাকা করেই এনেছিলুম। গোরাকেও রাঞ্জি করেছিলুম, ইতিমধ্যে গোরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে বিনয় যথেষ্ট পরিমাণে হিন্দু নয়— মনু-পরাশরের সঙ্গে তার মতের একটু আধটু অনৈক্য হয়ে থাকে। তাই গোরা বেঁকে দাড়িয়েছে- গোরা বঁাকলে কেমন বীকে সে তো জােনই। কলিযুগের জনক। যদি পণ করতেন যে বঁকা গোরাকে সোজা করলে তবে সীতা দেব, তবে শ্ৰীরামচন্দ্ৰ হার মেনে যেতেন এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি। মনু-পরাশরের