পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8VE SR রবীন্দ্র-রচনাবলী বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কেন, পানুবাবুর সঙ্গে ওর বিবাহের কথা তো ঠিক হয়েই আছে- অন্তত আমরা তো মনে মনে তাই জানি- সুচরিতাও জানে ৷” পরেশ কহিলেন, “পানুবাবুকে রাধারানীর ঠিক পছন্দ হয় বলে আমার মনে হচ্ছে না।” বরদাসুন্দরী। দেখো, ঐগুলো আমার ভালো লাগে না। সুচরিতাকে আমার আপনি মেয়েদের থেকে কোনো তফাত করে দেখি নে, কিন্তু তাই বলে এ কথাও তো বলতে হয়। উনিই বা কী এমন অসামান্য । পানুবাবুর মতো বিদ্বান ধাৰ্মিক লোক যদি ওকে পছন্দ করে থাকে, সেটা কি উড়িয়ে দেবার জিনিস ? তুমি যাই বল, আমার লাবণ্যকে তো দেখতে ওর চেয়ে অনেক ভালো, কিন্তু আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। আমরা যাকে পছন্দ করে দেব ও তাকেই বিয়ে করবে, কখনো “না” বলবে না । তোমরা যদি সুচরিতার দেমাক বাড়িয়ে তোল তা হলে ওর পাত্ৰ মেলাই ভার হবে। পরেশ ইহার পরে আর কোনো কথাই বলিলেন না। বরদাসুন্দরীর সঙ্গে তিনি কোনোদিন তর্ক করিতেন না। বিশেষত সুচরিতার সম্বন্ধে। সতীশকে জন্ম দিয়া যখন সুচরিতার মা'র মৃত্যু হয় তখন সুচরিতার বয়স সাত। তাহার পিতা রামশরণ হালদার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ব্ৰাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন এবং পাড়ার লোকের অত্যাচারে গ্রাম ছাড়িয়া ঢাকায় আসিয়া আশ্রয় লন । সেখানে পোস্ট আপিসের কাজে যখন নিযুক্ত ছিলেন তখন সুল সঙ্গ স্থার ঘন বন্ধু হয়। কৃতি স্তন হতে পােরশন্তে ঠিক নেিজর পিতার মতেই রামশরণের মৃত্যু হঠাৎ ঘটিয়াছিল। তাহার টাকাকড়ি যাহা-কিছু ছিল তাহা তীহার ছেলে ও মেয়ের নামে দুই ভাগে দান করিয়া তিনি উইলপত্রে পরেশবাবুকে ব্যবস্থা করিবার ভার দিয়াছিলেন। তখন হইতে সতীশ ও সুচরিতা পরেশের পরিবারভুক্ত হইয়া গিয়াছিল। ঘরের বা বাহিরের লোকে সুচরিতার প্রতি বিশেষ স্নেহ বা মনোযোগ করিলে বরদাসুন্দরীর মনে ভালো লাগিত না। অথচ যে কারণেই হউক সুচরিতা সকলের কােছ হইতেই স্নেহ ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিত। বরদাসুন্দরীর মেয়েরা তাহার ভালোবাসা লইয়া পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করিত। বিশেষত মেজো মেয়ে ললিতা তাহার ঈর্ষাপরায়ণ প্ৰণয়ের দ্বারা সুচরিতাকে দিনরাত্ৰি যেন আঁকড়িয়া থাকিতে চাহিত । , বরদাসুন্দরীর মনে এই আকাঙক্ষা ছিল । সুচরিতা তীহার মেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে মানুষ হইয়া এ সম্বন্ধে তাঁহাদের সমান ফল লাভ করিবে ইহা তঁহার পক্ষে সুখকর ছিল না। সেইজন্য ইস্কুলে যাইবার সময় সুচরিতার নানাপ্রকার বিঘ্ন ঘটিতে থাকিত । সেই সকল বিয়ের কারণ অনুমান করিয়া পরেশ সুচরিতার ইস্কুল বন্ধ করিয়া দিয়া তাহাকে নিজেই পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। শুধু তাই নয়, সুচরিতা বিশেষভাবে তঁহারই যেন সঙ্গিনীর মতো হইয়া উঠিল । তিনি তাহার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করিতেন, যেখানে যাইতেন তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন, যখন দূরে থাকিতে বাধ্য হইতেন তখন চিঠিতে বহুতর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া বিস্তারিত আলোচনা করিতেন । এমনি করিয়া সুচরিতার মন তাহার বয়স ও অবস্থাকে ছাড়াইয়া অনেকটা পরিণত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার মুখশ্ৰীতে ও আচরণে যে-একটি গান্তীর্যের বিকাশ হইয়াছিল তাহাতে কেহ তাহাকে বালিকা বলিয়া গণ্য করিতে পারিত না ; এবং লাবণ্য যদিচ বয়সে প্রায় তাহার সমান ছিল তবু সকল বিষয়ে সুচরিতাকে সে আপনার চেয়ে বড়ো বলিয়াই মনে করিত, এমন-কি, বরদাসুন্দরীও তাঁহাকে ইচ্ছা করিলেও কোনােমতেই তুচ্ছ করিতে পারিতেন না। পাঠকেরা পূর্বেই পরিচয় পাইয়াছেন হারানবাবু অত্যন্ত উৎসাহী ব্ৰাহ্ম ; ব্ৰাহ্ম-সমাজের সকল কাজেই তাহার হাত ছিল— তিনি নৈশ-স্কুলের শিক্ষক, কাগজের সম্পাদক, স্ত্রীবিদ্যালয়ের সেক্রেটারি— কিছুতেই তাহার শ্রান্তি ছিল না। এই যুবকটিই যে একদিন ব্ৰাহ্মসমাজে অত্যুচ্চ স্থান অধিকার করিবে সকলেরই মনে এই আশা ছিল। বিশেষত ইংরেজি ভাষায় তাহার অধিকার ও