পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8\O8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্বন্ধ- তাহাতে মানুষকে স্বভাবতই বিনয়ী করিয়া তোলে। তাহা না করিয়া যেখানে মানুষকে উদ্ধত ও অহংকৃত করে সেখানে মানুষ আপনার ক্ষুদ্রতাকে সেই সত্যের তুলনাতেই অত্যন্ত সুস্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করে। এইখানেই পরেশবাবুর সঙ্গে হারানের প্রভেদ সুচরিতা মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরেশবাবু ব্ৰাহ্মসমাজের নিকট হইতে যাহা লাভ করিয়াছেন তাহার সম্মুখে র্তাহার মাথা যেন সর্বদা নত হইয়া আছে- সে সম্বন্ধে তাহার লেশমাত্ৰ প্ৰগলভতা নাই— তাহার গভীরতার মধ্যে তিনি নিজের জীবনকে তলাইয়া দিয়াছেন। পরেশবাবুর শান্ত মুখচ্ছবি দেখিলে তিনি যে সত্যকে হৃদয়ে বহন করিতেছেন তাহারই মহত্ত্ব চোখে পড়ে। কিন্তু হারানবাবুর সেরূপ নহে— তাহার ব্ৰাহ্মত্ব বলিয়া একটা উগ্র আত্মপ্ৰকাশ অন্য সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়া তাহার সমস্ত কথায় ও কাজে অশোভন রূপে বাহির হইয়া থাকে। ইহাতে সম্প্রদায়ের কাছে তাহার আদর বাড়িয়ছিল ; কিন্তু সুচরিতা পরেশের শিক্ষাগুণে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ হইতে পারে নাই বলিয়া হারানবাবুর একান্ত ব্ৰাক্ষিকতা সুচরিতার স্বাভাবিক মানবত্বকে যেন পীড়া দিত। হারানবাবু মনে করিতেন, ধর্মসাধনার ফলে তাহার দৃষ্টিশক্তি এমন আশ্চর্য স্বচ্ছ হইয়াছে যে, অন্য সকল লোকেরই ভালোমন্দ ও সত্যাসত্য তিনি অতি অনায়াসেই বুঝিতে পারেন। এইজন্য সকলকেই তিনি সর্বদাই ভাষায় এই কাজ করে তাহদের সেই নিন্দার সঙ্গে আধ্যাত্মিক অহংকার মিশ্রিত হইয়া সংসারে একটা অত্যন্ত সুতীব্ৰ উপদ্রবের সৃষ্টি করে। সুচরিতা তাহা একেবারেই সহিতে পারিত না। ব্ৰাহ্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে সুচরিতার মনে যে কোনো গর্ব ছিল না। তাহা নহে, তথাপি ব্ৰাহ্মসমাজের মধ্যে যাহারা বড়োলোক তাহারা যে ব্ৰাহ্ম হওয়ারই দরুন বিশেষ একটা শক্তি লাভ করিয়া বড়ো হইয়াছেন এবং ব্ৰাহ্মসমাজের বাহিরে যাহারা চরিত্ৰভ্ৰষ্ট তাহারা যে ব্ৰাহ্ম না হওয়ারই কারণে বিশেষভাবে শক্তিহীন হইয়া নষ্ট হইয়াছে। এ কথা লইয়া হারানবাবুর সঙ্গে সুচরিতার অনেক বার তর্ক হইয়া গিয়াছে। হারানবাবু ব্ৰাহ্মসমাজের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ করিয়া যখন বিচারে পরেশবাবুকেও অপরাধী করিতে ছাড়িতেন না। তখনই সুচরিতা যেন আহত ফণিনীর মতো অসহিষ্ণু হইয়া উঠিত । সে সময়ে বাংলাদেশে ইংরেজিশিক্ষিত দলের মধ্যে ভগবদগীতা লইয়া আলোচনা ছিল না। কিন্তু পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া মাঝে মাঝে গীতা পড়িতেন- কালীসিংহের মহাভারতও তিনি প্রায় সমস্তটা সুচরিতাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন । হারানবাবুর কাছে তাহা ভালো লাগে নাই। এ-সমস্ত গ্ৰন্থ তিনি ব্ৰহ্মপরিবার হইতে নির্বাসিত করিবার পক্ষপাতী। তিনি নিজেও এগুলি পড়েন নাই | রামায়ণ-মহাভারত-ভগবদগীতাকে তিনি হিন্দুদের সামগ্ৰী বলিয়া স্বতন্ত্র রাখিতে চাহিতেন। ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বাইবেলই তাহার একমাত্র অবলম্বন ছিল। পরেশবাবু যে তাহার শাস্ত্রচর্চা এবং ছােটােখাটাে নানা বিষয়ে ব্ৰাহ্ম-অব্রান্ধের সীমা রক্ষা করিয়া চলিতেন না, তাহাতে হারানের গায়ে যেন কাটা বিধিত । পরেশের আচরণে প্রকাশ্যে বা মনে মনে কেহ কোনোপ্রকার দোষারোপ করিবে এমন স্পর্ধা সুচরিতা কখনোই সহিতে পারে না। এবং এইরূপ স্পর্ধা প্রকাশ হইয়া পড়াতেই হারানবাবু সুচরিতার কাছে খাটো হইয়া গেছেন । এইরূপে নানা কারণে হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে দিনে দিনে নিম্প্রভ হইয়া আসিতেছেন। বরদাসুন্দরীও যদিচ ব্ৰাহ্ম-অব্রাহ্মের ভেদরক্ষায় হারানবাবুর অপেক্ষা কোনো অংশে কম উৎসাহী নহেন এবং তিনিও তাহার স্বামীর আচরণে অনেক সময় লজ্জা বোধ করিয়া থাকেন, তথাপি হারানবাবুকে তিনি আদর্শ পুরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন না। হারানবাবুর সহস্ৰ দোষ তাহার চােখে পড়িত । হারানবাবুর সাম্প্রদায়িক উৎসাহের অত্যাচারে এবং সংকীর্ণ নীরসন্তায় যদিও সুচরিতার মন ভিতরে ভিতরে প্রতিদিন তাহার উপর হইতে বিমুখ হইতেছিল, তথাপি হারানবাবুর সঙ্গেই যে তাহার বিবাহ হইবে এ সম্বন্ধে কোনো পক্ষের মনে কোনো তর্ক বা সন্দেহ ছিল না । ধর্মসামাজিক দোকানে যে ব্যক্তি নিজের উপরে খুব বড়ো অক্ষরে উচ্চ মূল্যের টিকিট মারিয়া রাখে অন্য লোকেও ক্রমে ক্রমে তাহার