পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8ᏔᏬᏄ হারানবাবু নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হওয়ায় লজ্জিত হইয়া কহিলেন, “নিশ্চয়ই কর্তব্য। কেবল আমার ইচ্ছা এই যে, একদিন সকলকে ডেকে ঈশ্বরের নাম করে সম্বন্ধটা পাকা করা হােক।” পরেশবাবু কহিলেন, “সে অতি উত্তম প্রস্তাব।” SA ঘণ্টা দুই-তিন নিদ্রার পর যখন গোরা ঘুম ভাঙিয়া পাশে চাহিয়া দেখিল বিনয় ঘুমাইতেছে তখন তাহার হৃদয় আনন্দে ভরিয়া উঠিল । স্বপ্নে একটা প্রিয় জিনিস হারাইয়া জাগিয়া উঠিয়া যখন দেখা যায় তাহা হারায় নাই তখন যেমন আরাম বোধ হয় গোরার সেইরূপ হইল। বিনয়কে ত্যাগ করিলে গোরার জীবন যে কতখানি পঙ্গু হইয়া পড়ে আজ নিদ্রাভঙ্গে বিনয়কে পাশে দেখিয়া তাহা সে অনুভব করিতে পরিল | এই আনন্দের আঘাতে চঞ্চল হইয়া গোরা ঠেলাঠেলি করিয়া বিনয়কে জাগাইয়া দিল এবং কহিল, “চলো, একটা কাজ আছে।” গোরার প্রত্যহ সকালবেলায় একটা নিয়মিত কাজ ছিল । সে পাড়ার নিম্নশ্রেণীর লোকদের ঘরে যাতায়াত করিত | তাহদের উপকার করিবার বা উপদেশ দিবার জন্য নহে— নিতান্তই তাহদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যই যাইত । শিক্ষিত দলের মধ্যে তাহার এরূপ যাতায়াতের সম্বন্ধ ছিল না। বলিলেই হয়। গোরাকে ইহারা দাদাঠাকুর বলিত এবং কড়িবাধা ছক দিয়া অভ্যর্থনা করিত। কেবলমাত্র ইহাদের আতিথ্য গ্রহণ করিবার জন্যই গোরা জোর করিয়া তামাক খাওয়া ধরিয়াছিল। এই দলের মধ্যে নন্দ গোরার সর্বপ্রধান ভক্ত ছিল । নন্দ ছুতারের ছেলে। বয়স বাইশ । সে তাহার বাপের দোকানে কাঠের বাক্স তৈয়ারি করিত। ধাপার মাঠে শিকারির দলে নন্দর মতো অব্যৰ্থ বন্দুকের লক্ষ কাহারও ছিল না। ক্রিকেট খেলায় গোলা ছুড়িতেও সে অদ্বিতীয় ছিল। গোরা তাহার শিকার ও ক্রিকেটের দলে ভদ্র ছাত্রদের সঙ্গে এই-সকল ছুতার-কামারের ছেলেদের একসঙ্গে মিলাইয়া লইয়াছিল | এই মিশ্রিত দলের মধ্যে নন্দ সকলপ্রকার খেলায় ও ব্যায়ামে সকলের সেরা ছিল। ভদ্র ছাত্রেরা কেহ কেহ তাহার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল, কিন্তু গোরার শাসনে সকলেরই তাহাকে দলপতি বলিয়া স্বীকার করিতে হইত। এই নন্দর পায়ে কয়েক দিন হইল একটা বাটালি পড়িয়া গিয়া ক্ষত হওয়ায় সে খেলার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল। বিনয়কে লইয়া এই কয়দিন গোরার মন বিকল ছিল, সে তাঁহাদের বাড়িতে যাইতে পারে নাই। আজ প্রভাতেই বিনয়কে সঙ্গে করিয়া সে ছুতারপাড়ায় গিয়া উপস্থিত হইল। গেল। নন্দর বাপ বা অন্য পুরুষ অভিভাবক বাড়িতে নাই। পাশে একটি তামাকের দোকান ছিল (१छ ।” নন্দ মারা গিয়াছে ! এমন স্বাস্থ্য, এমন শক্তি, এমন তেজ, এমন হৃদয়, এত অল্প বয়স- সেই নন্দ আজ ভোরবেলায় মারা গিয়াছে। সমস্ত শরীর শক্ত করিয়া গোরা স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া রহিল । নন্দ একজন সামান্য ছুতারের ছেলে— তাহার অভাবে ক্ষণকালের জন্য সংসারে যেটুকু ফাক পড়িল তাহা অতি অল্প লোকেরই চােখে পড়বে, কিন্তু আজ গােরার কাছে নন্দর মৃত্যু নিদারুণরূপে অসংগত ও অসম্ভব বলিয়া ঠেকিল। গোরা যে দেখিয়াছে তাহার প্রাণ ছিল- এত লোক তো বাচিয়া আছে, কিন্তু তাহার মতো এত প্রচুর প্রাণ কোথায় দেখিতে পাওয়া যায় ! কী করিয়া তাহার মৃত্যু হইল খবর লইতে গিয়া শোনা গেল যে, তাহার ধনুষ্টঙ্কার হইয়াছিল। নন্দর বাপ ডাক্তার আনিবার প্রস্তাব করিয়াছিল, কিন্তু নন্দর মা জোর করিয়া বলিল, তাহার ছেলেকে ভূতে পাইয়াছে। ভূতের ওঝা কাল সমস্ত রাত তাহার গায়ে হেঁকা দিয়াছে, তাহাকে মারিয়াছে এবং মন্ত্র পড়িয়াছে। ব্যামোর আরম্ভে গোরাকে খবর দিবার জন্য নন্দ একবার অনুরোধ করিয়াছিল- কিন্তু