পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80. Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী বলেছিলেন মেয়েরা বাঘকে ভয় করে- আপনি কাউকে ভয় করেন না নাকি ?” ইহার পরে সেদিন মেয়েদের লইয়া বিনয় সার্কাসে গিয়াছিল। শুধু তাই নয়, গোরার সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটা ললিতার এবং সম্ভবত এ বাড়ির অন্য মেয়েদের কাছে কিরূপ ভাবে প্ৰতিভাত হইয়াছে সে কথাটাও বার বার তাহার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল । তাহার পরে যেদিন বিনয়ের সঙ্গে দেখা হইল ললিতা যেন নিরীহ কৌতুহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিল, “গীেরমোহনবাবুকে সেদিনকার সার্কাসের গল্প বলেছেন ? এ প্রশ্নের খোচা বিনয়কে গভীর করিয়া বাজিল— কেননা তাহাকে কৰ্ণমূল রক্তবর্ণ করিয়া বলিতে হইল, “না, এখনো বলা হয় নি।” লাবণ্য আসিয়া ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “বিনয়বাবু আসুন না।” ললিতা কহিল, “কোথায় ? সার্কাসে নাকি ?” লাবণ্য কহিল, “বাঃ, আজ আবার সার্কাস কোথায় ? আমি ডাকছি। আমার রুমালের চার ধারে পেনসিল দিয়ে একটা পাড় একে দিতে— আমি সেলাই করব। বিনয়বাবুকী সুন্দর আঁকতে পারেন!” লাবণ্য বিনয়কে ধরিয়া লইয়া গেল । Σ δ সকালবেলায় গোরা কাজ করিতেছিল। বিনয় খামক আসিয়া অত্যন্ত খাপছাড়াভাবে কহিল, গোরা লিখিতে লিখিতেই বলিল, “শুনেছি।” বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “তুমি কার কাছে শুনলে ?” গোরা । অবিনাশের কাছে । সেও সেদিন সার্কাস দেখতে গিয়েছিল । গোরা আর কিছু না বলিয়া লিখিতে লাগিল। গোরা এ খবরটা আগেই শুনিয়াছে, সেও আবার অবিনাশের কােছ হইতে শুনিয়াছে, সুতরাং তাঁহাতে বর্ণনা ও ব্যাখ্যার কোনো অভাব ঘটে নাই— ইহাতে তাহার চিরসংস্কারবশত বিনয় মনের মধ্যে ভারি একটা সংকোচ বোধ করিল। সার্কাসে যাওয়া এবং এ কথাটা এমন করিয়া লোকসমাজে না উঠিলেই সে খুশি হইত। এমন সময়ে তাহার মনে পড়িয়া গেল কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত না ঘুমাইয়া সে মনে মনে ললিতার সঙ্গে ঝগড়া করিয়াছে। ললিতা মনে করে সে গোরাকে ভয় করে এবং ছোটাে ছেলে যেমন করিয়া মাস্টারকে মানে তেমনি করিয়াই সে গোরাকে মানিয়া চলে। এমন অন্যায় করিয়াও মানুষকে মানুষ ভুল বুঝিতে পারে ! গোরা বিনয় যে একাত্মা ; অসামান্যতাগুণে গোরার উপরে তাহার একটা ভক্তি আছে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া ললিতা যে-রকমটা মনে করিয়াছে সেটা গোরার প্রতিও অন্যায় বিনয়ের প্ৰতিও অন্যায় । বিনয় নাবালক নয় এবং গোরাও নাবালকের অছি নহে। গোরা নিঃশব্দে লিখিয়া যাইতে লাগিল, আর ললিতার মুখের সেই তীক্ষাগ্র গুটি দুই-তিন প্রশ্ন বার বার বিনয়ের মনে পড়িল। বিনয় তাহাকে সহজে বরখাস্ত করিতে পারিল না। দেখিতে দেখিতে বিনয়ের মনে একটা বিদ্রোহ মাথা তুলিয়া উঠিল । সার্কাস দেখিতে গিয়াছি তো কী হইয়াছে! অবিনাশ কে, যে, সে সেই কথা লইয়া গোরার সঙ্গে আলোচনা করিতে আসে- এবং গোরাই বা কেন আমার গতিবিধি সম্বন্ধে সেই অকালকুম্মাণ্ডের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেয় । আমি কি গোরার নজরবন্দী ! কাহার সঙ্গে মিশিব, কোথায় যাইব, গোরার কাছে তাহার জবাবদিহি করিতে হইবে ! বন্ধুত্বের প্রতি এ যে বিষম উপদ্রব।” গোরা ও অবিনাশের উপর বিনয়ের এত রাগ হইত না। যদি সে নিজের ভীরুতাকে নিজের মধ্যে সহসা স্পষ্ট করিয়া উপলব্ধি না করিত । গোরার কাছে যে সে কোনো কথা ক্ষণকালের জন্যও ঢাকাঢাকি করিতে বাধ্য হইয়াছে সেজন্য সে আজ মনে মনে যেন গোরাকেই অপরাধী করিতে চেষ্টা করিতেছে। সার্কাসে যাওয়া লইয়া গোরা যদি বিনয়ের সঙ্গে দুটাে ঝগড়ার কথা বলিত তাহা হইলেও