পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(53. 86 ዓ আমার একটা কথা আছে।” সুচরিতা একেবারে চমকিয়া উঠিল। তাহাকে কে যেন মারিল । হারানবাবুর সহিত তাহার যেরূপ সম্বন্ধ তাঁহাতে তিনি যে কখনাে তাহাকে এরূপ আহবান করিতে পারেন না তাহা নহে। অন্য সময় হইলে সে কিছু মনেই করিত না ; কিন্তু আজ গোরা ও বিনয়ের সম্মুখে সে নিজেকে অপমানিত বোধ করিল। বিশেষত গোরা তাহার মুখের দিকে এমন একরকম করিয়া চাহিল যে, সে হারানবাবুকে ক্ষমা করিতে পারিল না। প্রথমটা, সে যেন কিছুই শুনিতে পায় নাই এমনিভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। হারানবাবু তখন কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্তি প্ৰকাশ করিয়া কহিলেন, “শুনিছ সুচরিতা ? আমার একটা কথা আছে, একবার এ ঘরে আসতে হবে ।” সুচরিতা তাহার মুখের দিকে না তাকাইয়াই কহিল, “এখন থাক— বাবা আসুন, তার পরে হবে।” সুচরিতা তাড়াতাড়ি কহিল, “না বিনয়বাবু, উঠবেন না। বাবা আপনাদের থাকতে বলেছেন । তিনি এলেন বলে ।” তাহার কণ্ঠস্বরে একটা ব্যাকুল অনুনয়ের ভাব প্রকাশ পাইল । হরিণীকে যেন ব্যাধের হাতে ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাব হইয়াছিল । “আমি আর থাকতে পারছি নে, আমি তবে চললুম” বলিয়া হারানবাবু দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। রাগের মাথায় বাহির হইয়া আসিয়া পরীক্ষণেই তাহার অনুতাপ হইতে লাগিল, কিন্তু তখন ফিরিবার আর কোনো উপলক্ষ খুঁজিয়া পাইলেন না। হারানবাবু চলিয়া গেলে সুচরিতা একটা কোন সুগভীর লজ্জায় মুখ যখন রক্তিম ও নত করিয়া বসিয়া ছিল, কী করিবে কী বলিবে কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, সেই সময়ে গোরা তাহার মুখের দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া লইবার অবকাশ পাইয়াছিল। গোরা শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য, যে প্ৰগলভ্যতা কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল, সুচরিতার মুখশ্ৰীতে তাহার আভাসমােত্র কোথায় ! তাহার মুখে বুদ্ধির একটা উজ্জ্বলতা নিঃসন্দেহ প্রকাশ পাইতেছিল, কিন্তু নম্রতা ও লজ্জার দ্বারা তাহা কী সুন্দর কোমল হইয়া আজ দেখা দিয়াছে! মুখের ডোলটি কী সুকুমার ! ভ্ৰযুগলের উপরে ললাটটি যেন শরতের আকাশখণ্ডের মতো নির্মল ও স্বচ্ছ । ঠোঁট দুটি চুপ করিয়া আছে, কিন্তু অনুচ্চারিত কথার মাধুর্য সেই দুটি ঠোঁটের মাঝখানে যেন কোমল একটি কুঁড়ির মতো রহিয়াছে। নবীনা রমণীর বেশভূষার প্রতি গোরা পূর্বে কোনোদিন ভালো করিয়া চাহিয়া দেখে নাই এবং না দেখিয়াই সে-সমস্তের প্রতি তাহার একটা ধিক্কারভাব ছিল— আজি সুচরিতার দেহে তাহার নূতন ধরনের শাড়ি পরার ভঙ্গি তাহার একটু বিশেষভাবে ভালো লাগিল ; সুচরিতার একটি হাত টেবিলের উপরে ছিল— তাহার জামার আস্তিনের কুঞ্চিত প্ৰান্ত হইতে সে হাতখনি আজ গোরার চোখে কোমল হৃদয়ের একটি কল্যাণপূর্ণ বাণীর মতো বােধ হইল। দীপালোকিত শান্ত সন্ধ্যায় সুচরিতাকে বেষ্টন করিয়া সমস্ত ঘরটি তাহার আলো, তাহার দেয়ালের ছবি, তাহার গৃহসজ্জা, তাহার পারিপাট্য লইয়া একটি যেন বিশেষ অখণ্ড রূপ ধারণ করিয়া দেখা দিল। তাহা যে গৃহ, তাহা যে সেবাকুশলা নারীর যত্নে স্নেহে সৌন্দর্যে মণ্ডিত, তাহা যে দেয়াল ও কড়ি বরগা ছাদের চেয়ে অনেক বেশি— ইহা আজ গোরার কাছে মুহুর্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল। গোরা আপনার চতুর্দিকের আকাশের মধ্যে একটা সজীব সত্তা অনুভব করিল— তাহার হৃদয়কে চারি দিক হইতেই একটা হৃদয়ের হিল্লোল আসিয়া আঘাত করিতে লাগিল, একটা কিসের নিবিড়তা তাহাকে যেন বেষ্টন করিয়া ধরল। এরূপ অপূর্ব উপলব্ধি তাহার জীবনে কোনোদিন ঘটে নাই। দেখিতে দেখিতে ক্রমশই সুচরিতার কপালের ভ্ৰষ্ট কেশ হইতে তাহার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়াটুকু পর্যন্ত অত্যন্ত সত্য এবং অত্যন্ত বিশেষ হইয়া উঠিল। একই কালে সমগ্রভাবে সুচরিতা এবং সুচরিতার প্রত্যেক অংশ স্বতন্ত্রভাবে গোরার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করিতে লাগিল । কিছুক্ষণ কেহ কোনো কথা কহিতে না পারিয়া সকলেই একপ্রকার কুষ্ঠিত হইয়া পড়িল। তখন মুমুক্তর দিকে চাহিয়া কহিল "সেদিন আমাদের কথা হচ্ছিল।”— বলিয়া একটা কথা উত্থাপন शों क्लि ।