পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

86 v রবীন্দ্র রচনাবলী সে কহিল, “আপনাকে তো বলেইছি, আমার এমন একদিন ছিল যখন আমার মনে বিশ্বাস ছিল, নাবালকের মতো কটাব এবং ইংরেজ আমাদের অছি নিযুক্ত হয়ে থাকবে- যেখানে যা যেমন আছে সেইরকমই থেকে যাবে- ইংরেজের প্রবল শক্তি এবং সমাজের প্রবল জড়তার বিরুদ্ধে আমাদের কোথাও কোনো উপায়মাত্র নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকেরই এইরকম মনের ভাব | এমন অবস্থায় মানুষ, হয় নিজের স্বাৰ্থ নিয়েই থাকে নয়। উদাসীনভাবে কাটায়। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত লোকেরা এই কারণেই চাকরির উন্নতি ছাড়া আর-কোনো কথা ভাবে না, ধনী লোকেরা গবর্মেন্টের খেতাব পেলেই জীবন সার্থক বােধ করে— আমাদের জীবনের যাত্রাপথটা অল্প একটু দূরে গিয়েই, বাস, ঠেকে যায়— সুতরাং সুদূর উদ্দেশ্যের কল্পনাও আমাদের মাথায় আসে না, আর তার পাথেয়-সংগ্রহও অনাবশ্যক বলে মনে করি। আমিও এক সময়ে ঠিক করেছিলুম গোরার বাবাকে মুরুব্বি ধরে একটা চাকরির জোগাড় করে নেব । এমন সময় গোরা আমাকে বললে- না, গবর্মেন্টের চাকরি তুমি কোনােমতেই করতে পারবে না।” গোরা এই কথায় সুচরিতার মুখে একটুখানি বিস্ময়ের আভাস দেখিয়া কহিল, “আপনি মনে করবেন না। গবমেন্টের উপর রাগ করে আমি এমন কথা বলছি । গবমেন্টের কাজ যারা করে তারা গবমেন্টের শক্তিকে নিজের শক্তি বলে একটা গর্ব বোধ করে এবং দেশের লোকের থেকে একটা ভিন্ন শ্রেণীর হয়ে ওঠে- যত দিন যাচ্ছে আমাদের এই ভাবটা ততই বেড়ে উঠছে। আমি জানি আমার একটি আত্মীয় সাবেক কালের ডেপুটি ছিলেন— এখন তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। তাকে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট জিজ্ঞাসা করেছিলেন— বাবু, তোমার বিচারে এত বেশি লোক খালাস পায় কেন ? তিনি জবাব দিয়েছিলেন- সাহেব, তার একটি কারণ আছে ; তুমি যাদের জেলে দাও তারা তোমার পক্ষে কুকুর-বিড়াল মাত্র, আর আমি যাদের জেলে দিই তারা যে আমার ভাই হয় । এত বড়ো কথা বলতে পারে এমন ডেপুটি তখনো ছিল এবং শুনতে পারে এমন ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেটেরও অভাব ছিল না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে চাকরির দড়াব্দড়ি অঙ্গের ভূষণ হয়ে উঠছে এবং এখনকার ডেপুটির কাছে র্তর দেশের লোক ক্রমেই কুকুর-বিড়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এবং এমনি করে পদের উন্নতি হতে হতে র্তাদের যে কেবলই অধােগতি হচ্ছে। এ কথার অনুভূতি পর্যন্ত তাদের চলে যাচ্ছে। পরের কাধে ভর দিয়ে নিজের লোকদের নিচু করে দেখব এবং নিচু করে দেখবামােত্রই তাদের প্রতি অবিচার করতে বাধ্য হব, এতে কোনো মঙ্গল হতে পারে না ।” বলিয়া গোরা টেবিলে একটা মুষ্টি আঘাত করিল ; তেলের শেজটা কঁপিয়া উঠিল। বিনয় কহিল, “গোরা, এ টেবিলটা গবর্মেন্টের নয়, আর এই শেজটা পরেশবাবুদের।” শুনিয়া গোরা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল । তাহার হাস্যের প্রবল ধ্বনিতে সমস্ত বাড়িটা পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ঠাট্টা শুনিয়া গোরা যে ছেলেমানুষের মতো এমন প্রচুরভাবে হাসিয়া উঠিতে পারে ইহাতে সুচরিতা আশ্চর্য বােধ করিল এবং তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা আনন্দ হইল। যাহারা বড়ো কথার চিস্তা করে তাহারা যে প্ৰাণ খুলিয়া হাসিতে পারে এ কথা তাহার জানা ছিল না। গোরা সেদিন অনেক কথাই বলিল। সুচরিতা যদিও চুপ করিয়া ছিল। কিন্তু তাহার মুখের ভাবে গোরা এমন একটা সায় পাইল যে, উৎসাহে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। শেষকালে সুচরিতাকেই যেন বিশেষভাবে সম্বোধন করিয়া কহিল, “দেখুন, একটি কথা মনে রাখবেন— যদি এমন ভুল সংস্কার আমাদের হয় যে, ইংরেজরা যখন প্রবল হয়ে উঠেছে তখন আমরাও ঠিক ইংরেজটি না হলে কোনোমতে প্রবল হতে পারব না, তা হলে সে অসম্ভব কোনোদিন সম্ভব হবে না এবং কেবলই নকল করতে করতে আমরা দুয়ের বার হয়ে যাব। এ কথা নিশ্চয় জানবেন ভারতের একটা বিশেষ প্রকৃতি, বিশেষ শক্তি, বিশেষ সত্য আছে, সেইটের পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারাই ভারত সাৰ্থক হবে, ভারত রক্ষা পাবে। ইংরেজের ইতিহাস পড়ে এইটে যদি আমরা না শিখে থাকি তবে সমস্তই ভুল শিখেছি। আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ, আপনি ভারতবর্ষের ভিতরে আসুন, এর সমস্ত ভালেমদের