পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8GS মাঝখানেই নেবে দাঁড়ােন,- যদি বিকৃতি থাকে, তবে ভিতর থেকে সংশোধন করে তুলুন, কিন্তু একে দেখুন, বুঝুন, ভাবুন, এর দিকে মুখ ফেরান, এর সঙ্গে এক হােন— এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, বাইরে থেকে খৃস্টানি সংস্কারে বাল্যকাল হতে অস্থিমজ্জায় দীক্ষিত হয়ে, একে আপনি বুঝতেই পারবেন না, একে কেবলই আঘাত করতেই থাকবেন, এর কোনো কাজেই লাগবেন না।” গোরা বলিল বটে, “আমার অনুরোধ ; কিন্তু এ তো অনুরোধ নয়, এ যেন আদেশ । কথার মধ্যে এমন একটা প্ৰচণ্ড জোর যে, তাহা অন্যের সম্মতির অপেক্ষাই করে না । সুচরিতা মুখ নত করিয়াই সমস্ত শুনিল । এমন একটা প্রবল আগ্রহের সঙ্গে গোরা যে তাহাকেই বিশেষভাবে সম্বোধন করিয়া এই ৷ কথা কয়টি কহিল তাহাতে সুচরিতার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত করিয়া দিল । সে আন্দােলন যে কিসের তখন তাহা ভাবিবার সময় ছিল না। ভারতবর্ষ বলিয়া যে একটা বৃহৎ প্রাচীন সত্তা আছে সুচরিতা সে কথা কোনোদিন এক মুহুর্তের জন্যও ভাবে নাই। এই সত্তা যে দূর অতীত ও সুদূর ভবিষ্যৎকে অধিকারপূর্বক নিভৃতে থাকিয়া মানবের বিরাট ভাগ্যজালে একটা বিশেষ রঙের সূতা একটা বিশেষ ভাবে বুনিয়া চলিয়াছে ; সেই সুতা যে কত সূক্ষ্ম, কত বিচিত্র এবং কত সুদূর সার্থকতার সহিত তাহার কত নিগুঢ় সম্বন্ধ— সুচরিতা আজ তাহা গোরার প্রবল কণ্ঠের কথা শুনিয়া যেন হঠাৎ একরকম করিয়া উপলব্ধি করিল। প্রত্যেক ভারতবাসীর জীবন যে এত বড়ো একটা সত্তার দ্বার বেষ্টিত, অধিকৃত, তাহা সচেতনভাবে অনুভব না করিলে আমরা যে কতই ছোটাে হইয়া এবং চারি দিক সম্বন্ধে কতই অন্ধ হইয়া কাজ করিয়া যাই নিমেষের মধ্যেই তাহা যেন সুচরিতার কাছে প্রকাশ পাইল । সেই অকস্মাৎ চিত্তস্ফুর্তির আবেগে সুচরিতা তাহার সমস্ত সংকোচ দূর করিয়া দিয়া অত্যন্ত সহজ বিনয়ের সহিত কহিল, “আমি দেশের কথা কখনো এমন করে, বড়ো করে, সত্য করে ভাবি নি। কিন্তু একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি।- ধর্মের সঙ্গে দেশের যোগ কী ? ধর্ম কি দেশের অতীত নয় ?” গোরার কানে সুচরিতার মৃদু কণ্ঠের এই প্রশ্ন বড়ো মধুর লাগিল। সুচরিতার বড়ো বড়ো দুইটি চােখের মধ্যে এই প্রশ্নটি আরো মধুর করিয়া দেখা দিল। গোরা কহিল, “দেশের অতীত যা, দেশের চেয়ে যা অনেক বড়ো, তাই দেশের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় । ঈশ্বর এমনি করে বিচিত্ৰ ভাবে আপনার অনন্ত স্বরূপকেই ব্যক্ত করছেন । র্যারা বলেন সত্য এক, অতএব কেবলই একটি ধর্মই সত্য, ধর্মের একটিমাত্র রূপই সত্য— তারা, সত্য যে এক কেবল এই সত্যটিই মানেন, আর সত্য যে অন্তহীন সে সত্যটা মানতে চান না । অন্তহীন-এক অন্তহীন অনেকে আপনাকে প্রকাশ করেন- জগতে সেই লীলাই তো দেখছি। সেইজন্যেই ধর্মমত বিচিত্র হয়ে সেই ধৰ্মরাজকে নানা দিক দিয়ে উপলব্ধি করাচ্ছে। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, ভারতবর্ষের খোলা জানলা দিয়ে আপনি সূর্যকে দেখতে পাবেন— সেজন্যে সমুদ্রপারে গিয়ে খৃস্টান গির্জার জানলায় বসবার কোনাে দরকার হবে না।” সুচরিতা কহিল, “আপনি বলতে চান, ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র একটি বিশেষ পথ দিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়। সেই বিশেষত্বটি কী ?” গােরা কহিল, “সেটা হচ্ছে এই যে, ব্ৰহ্ম যিনি নির্বিশেষ তিনি বিশেষের মধ্যেই ব্যক্ত। কিন্তু তীর বিশেষের শেষ নেই। জল তার বিশেষ, স্থল তীর বিশেষ, বায়ু তীর বিশেষ, অগ্নি তীর বিশেষ, প্ৰাণ তীর বিশেষ, বুদ্ধি প্রেম সমস্তই তার বিশেষ— গণনা করে কোথাও তীর অন্ত পাওয়া যায় না— বিজ্ঞান তাই নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে মরছে। যিনি নিরাকার তীর আকারের অন্ত নেই—হ্রস্বদীর্ঘ স্কুলসূক্ষ্মের অনন্ত প্রবাহই তার। যিনি অনন্তবিশেষ তিনিই নির্বিশেষ, যিনি অনন্তরূপ তিনিই অরূপ। অন্যান্য দেশে ঈশ্বরকে নুনাধিক পরিমাণে কোনাে একটিমাত্র বিশেষের মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করেছে— ভারতবর্ষেও ঈশ্বরকে বিশেষের মধ্যে দেখবার চেষ্টা আছে বটে, কিন্তু সেই বিশেষকেই ভারতবর্ষ একমাত্র ও চূড়ান্ত বলে গণ্য করে না। ঈশ্বর যে সেই বিশেষকেও অনন্তগুণে অতিক্রম করে আছেন এ কথা ভারতবর্ষের কোনো ভক্ত কোনোদিন অস্বীকার করেন না ।” সুচরিতা কহিল, “জ্ঞানী করেন না, কিন্তু অজ্ঞানী ?” গোরা কহিল, “আমি তো পূর্বেই বলেছি অজ্ঞানী সকল দেশেই সকল সত্যকেই বিকৃত করবে।” VOO