পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8や2O রবীন্দ্র-রচনাবলী সুচরিতা কহিল, “কিন্তু আমাদের দেশে সেই বিকার কি বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছয় নি ?” গোরা কহিল, “তা হতে পারে। কিন্তু তার কারণ ধর্মের স্কুল ও সূক্ষ্ম, অন্তর ও বাহির, শরীর ও আত্মা, এই দুটাে অঙ্গকেই ভারতবর্ষ পূর্ণভাবে স্বীকার করতে চায় বলেই যারা সূক্ষ্মকে গ্রহণ করতে পারে না তারা স্কুলটাকেই নেয় এবং অজ্ঞানের দ্বারা সেই স্কুলের মধ্যে নানা অদ্ভুত বিকার ঘটাতে থাকে। কিন্তু যিনি রূপেও সত্য অরূপেও সত্য, স্কুলেও সত্য সূক্ষ্মেীও সত্য, ধ্যানেও সত্য প্রত্যক্ষেও সত্য, তাকে ভারতবর্ষ সর্বতোভাবে দেহে মনে কর্মে উপলব্ধি করবার যে আশ্চর্য বিচিত্র ও প্রকাণ্ড চেষ্টা মিশ্রিত একটা সংকীর্ণ নীরস অঙ্গহীন ধর্মকেই একমাত্র ধর্ম বলে গ্রহণ করব। এ হতেই পারে না । আমি যা বলছি তা আপনাদের আশৈশবের সংস্কারবশত ভালো করে বুঝতেই পারবেন না, মনে করবেন। এ লোকটার ইংরেজি শিখেও শিক্ষার কোনো ফল হয় নি ; কিন্তু ভারতবর্ষের সত্য প্রকৃতি ও সত্যু সাধনার প্রতি যদি আপনার কোনোদিন শ্রদ্ধা জন্মে, ভারতবর্ষ নিজেকে সহস্ৰ বাধা ও বিকৃতির ভিতর দিয়েও যেরকম করে প্রকাশ করছে সেই প্রকাশের গভীর অভ্যন্তরে যদি প্রবেশ করতে পারেন, তা হলে- তা হলে, কী আর বলব, আপনার ভারতবষীয় স্বভাবকে শক্তিকে ফিরে পেয়ে আপনি মুক্তি লাভ করবেন । সুচরিতা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল দেখিয়া গোরা কহিল, “আমাকে আপনি একটা গোড়া ব্যক্তি বলে মনে করবেন না। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে গোড়া লোকেরা, বিশেষত যারা হঠাৎ নতুন গোড়া হয়ে উঠেছে, তারা যে ভাবে কথা কয় আমার কথা সে ভাবে গ্রহণ করবেন না। ভারতবর্ষের নানাপ্রকার প্রকাশে এবং বিচিত্র চেষ্টার মধ্যে আমি একটা গভীর ও বৃহৎ ঐক্য দেখতে পেয়েছি, সেই ঐক্যের আনন্দে আমি পাগল। সেই ঐক্যের আনন্দেই, ভারতবর্ষের মধ্যে যারা মূঢ়তম তাদের সঙ্গে এক দলে মিশে ধুলোয় গিয়ে বসতে আমার মনে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ হয় না। ভারতবর্ষের এই বাণী কেউ বা বোঝে, কেউ বা বোঝে না- তা নাই হল- আমি আমার ভারতবর্ষের সকলের সঙ্গে এক- তারা আমার সকলেই আপন— তাদের সকলের মধ্যেই চিরন্তন ভারতবর্ষের নিগুঢ় আবির্ভাব নিয়ত কাজ করছে, সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহমাত্র নেই।” গোরার প্রবল কণ্ঠের এই কথাগুলি ঘরের দেয়ালে টেবিলে, সমস্ত আসবাবপত্রেও যেন কঁাপিতে ढनव्नि । এ-সমস্ত কথা সুচরিতার পক্ষে খুব স্পষ্ট বুঝিবার কথা নহে- কিন্তু অনুভূতির প্রথম অস্পষ্ট সঞ্চারেরও বেগ অত্যন্ত প্ৰবল । জীবনটা যে নিতান্তই চারটে দেয়ালের মধ্যে বা একটা দলের মধ্যে বদ্ধ নহে, এই উপলব্ধিটা সুচরিতাকে যেন পীড়া দিতে লাগিল। এমন সময় সিঁড়ির কাছ হইতে মেয়েদের উচ্চহাস্যমিশ্ৰিত দ্রুত পদশব্দ শুনা গেল। বরদাসুন্দরী ও মেয়েদের লইয়া পরেশবাবু ফিরিয়াছেন। সুধীর সিঁড়ি দিয়া উঠিবার সময় মেয়েদের উপর কী একটা উৎপাত করিতেছে, তাহাই লইয়া এই হাস্যধ্বনির সৃষ্টি । লাবণ্য ললিতা ও সতীশ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়াই গোরাকে দেখিয়া সংষত হইয়া দাড়াইল । লাবণ্য ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলা- সতীশ বিনয়ের চৌকির পাশে দাড়াইয়া কানে কানে তাহার সহিত মুলুঙ্গা করিয়া দিল। ললিত কৃতির পশ্চাতে চৌকি টানিয়া তাহার আড়ালে অদৃশ্যপ্রায় হইয়া পরেশ আসিয়া কহিলেন, “আমার ফিরতে বড়ো দেরি হয়ে গেল। পানুবাবু বুঝি চলে গেছেন ?" সুচরিতা তাহার কোনো উত্তর দিল না ; বিনয় কহিল, “হা, তিনি থাকতে পারলেন না।” গোরা উঠিয়া কহিল, “আজ আমরাও আসি।” বলিয়া পরেশবাবুকে নত হইয়া নমস্কার করিল। . পরেশবাবু কহিলেন, “আজ আর তোমাদের সঙ্গে আলাপ করবার সময় পেলুম না। বাবা, যখন তোমার অবকাশ হবে মাঝে মাঝে এসো ।”