পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

89. রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকৃতি কোনোদিন গোরার মনকে আকর্ষণ করিবার অবকাশ পায় নাই। তাহার মন নিজের সচেষ্টতার বেগে নিজে কেবলই তরঙ্গিত হইয়া ছিল ; যে জল স্থল আকাশ অব্যবহিতভাবে তাহার চেষ্টার ক্ষেত্র নহে। তাহাকে সে লক্ষ্যই করে নাই । আজ কিন্তু নদীর উপরকার ঐ আকাশ আপনার নক্ষত্ৰলোকে অভিষিক্ত অন্ধকার-দ্বারা গোরার হৃদয়কে বারংবার নিঃশব্দে স্পর্শ করিতে লাগিল। নদী নিস্তরঙ্গ। কলিকাতার তীরের ঘাটে কতকগুলি নীেকায় আলো জ্বলিতেছে আর কতকগুলি দীপহীন নিস্তব্ধ। ও পারের নিবিড় গাছগুলির মধ্যে কালিমা ঘনীভূত। তাঁহারই উৰ্ব্বে বৃহস্পতিগ্রহ অন্ধকারের অন্তর্যামীর মতো তিমিরভেদী অনিমেষদৃষ্টিতে স্থির হইয়া আছে। । আজ এই বৃহৎ নিস্তব্ধ প্রকৃতি গোরার শরীর-মনকে যেন অভিভূত করিয়া দিল। গোরার হৃৎপিণ্ডের সমান তালে আকাশের বিরাট অন্ধকার স্পন্দিত হইতে লাগিল। প্রকৃতি এতকাল ধৈৰ্য ধরিয়া স্থির হইয়া ছিল— আজ গোরার অন্তঃকরণের কোন দ্বারটা খোলা পাইয়া সে মুহুর্তের মধ্যে এই অসতর্ক দুর্গটিকে আপনার করিয়া লইল। এতদিন নিজের বিদ্যা বুদ্ধি চিন্তা ও কর্ম লইয়া গোরা অত্যন্ত স্বতন্ত্র ছিল— আজি কী হইল! আজি কোনখানে সে প্রকৃতিকে স্বীকার করিল এবং করিবামােত্রই এই গভীর কালো জল, এই নিবিড় কালো তাঁট, ঐ উদার কালো আকাশ তাহাকে বরণ করিয়া লইল ! আজি প্রকৃতির কাছে কেমন করিয়া গোরা ধরা পড়িয়া গেছে। পথের ধারে সদাগরের আপিসের বাগানে কোন বিলাতি লতা হইতে একটা অপরিচিত ফুলের মৃদুকোমল গন্ধ গোরার ব্যাকুল হৃদয়ের উপর হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। নদী তাহাকে লোকালয়ের অশ্ৰান্ত কর্মক্ষেত্র হইতে কোন অনিৰ্দেশ্য সুদূরের দিকে আঙুল দেখাইয়া দিল ; সেখানে নির্জন জলের ধারে গাছগুলি শাখা মিলাইয়া কী ফুল ফুটাইয়াছে!! কী ছায়া ফেলিয়াছে! সেখানে নির্মল নীলাকাশের নীচে দিনগুলি যেন কাহার চােখের উল্মীলিত দৃষ্টি এবং রাতগুলি যেন কাহার চোখের আনত পল্লবের লজ্জাজড়িত ছায়া ! চারি দিক হইতে মাধুর্যের আবর্ত আসিয়া হঠাৎ গোরাকে যে-একটা অতলস্পর্শ অনাদি শক্তির আকর্ষণে টানিয়া লইয়া চলিল পূর্বে কোনােদিন সে তাহার কোনাে পরিচয় জানিত না। ইহা একই কালে বেদনায় এবং আনন্দে তাহার সমস্ত মনকে এক প্ৰান্ত হইতে আর-এক প্রান্তে অভিহিত করিতে লাগিল। আজ এই হেমন্তের রাত্রে, নদীর তীরে, নগরের অব্যক্ত কোলাহলে এবং নক্ষত্রের অপরিস্ফুট আলোকে গোরা বিশ্বব্যাপিনী কোন অবগুষ্ঠিতা মায়াবিনীর সম্মুখে আত্মবিস্মৃত হইয়া দণ্ডায়মান হইল! এই মহারানীকে সে এতদিন নতমস্তকে স্বীকার করে নাই বলিয়াই আজ অকস্মাৎ তাহার শাসনের ইন্দ্ৰজাল আপনি সহস্রবর্ণের সূত্রে গোরাকে জলস্থল আকাশের সঙ্গে চারি দিক হইতে বাধিয়া ফেলিল। গোরা নিজের সম্বন্ধে নিজেই বিস্মিত হইয়া নদীর জনশূন্য ঘাটের একটা পইঠায় বসিয়া পড়িল । বার বার সে নিজেকে প্রশ্ন করিতে লাগিল যে, তাহার জীবনে এ কিসের আবির্ভাব এবং ইহার কী প্রয়োজন ! যে সংকল্প-দ্বারা সে আপনার জীবনকে আগাগোড়া বিধিবদ্ধ করিয়া মনে মনে সাজাইয়া লইয়াছিল তাহার মধ্যে ইহার স্থান কোথায় ? ইহা কি তাহার বিরুদ্ধ ? সংগ্রাম করিয়া ইহাকে কি পরাস্ত করিতে হইবে ? এই বলিয়া গোরা মুষ্টি দৃঢ় করিয়া যখনই বদ্ধ করিল অমনি বুদ্ধিতে উজ্জ্বল, নম্রতায় কোমল, কোন দুইটি স্নিগ্ধ চক্ষুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাহার মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল— কোন অনিন্দ্যসুন্দর হাতখানির আঙুলগুলির স্পর্শসৌভাগ্যের অনাস্বাদিত অমৃত তাহার ধ্যানের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল ; গোরার সমস্ত শরীরে পুলকের বিদ্যুৎ চকিত হইয়া উঠিল। একাকী অন্ধকারের মধ্যে এই প্রগাঢ় অনুভূতি তাহার সমস্ত প্রশ্নকে, সমস্ত দ্বিধাকে একেবারে নিরন্ত করিয়া দিল। সে তাহার এই নূতন অনুভূতিকে সমস্ত দেহ মন দিয়া উপভোগ করিতে লাগিল— ইহাকে ছাড়িয়া সে উঠতে ইচ্ছা! कब्रिल नां । অনেক রাত্রে যখন গোরা বাড়ি গেল তখন আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত রাত করলে যে বাবা, তোমার খাবার যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।” গোরা কহিল, “কী জানি, মা, আজ কী মনে হল, অনেকক্ষণ গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলুম।"