পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8 VV) আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনয় সঙ্গে ছিল বুঝি ?” গোরা কহিল, “না, আমি একলাই ছিলুম।” আনন্দময়ী মনে মনে কিছু আশ্চর্য হইলেন। বিনা প্রয়োজনে গোরা যে এত রাত পর্যন্ত গঙ্গার ঘাটে বসিয়া ভাবিবে। এমন ঘটনা কখনোই হয় নাই। চুপ করিয়া বসিয়া ভাবা তাহার স্বভাবই নহে। গোরা কেমনতরো উতলা ভাবের উদ্দীপনা । আনন্দময়ী কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ বুঝি বিনয়ের বাড়ি গিয়েছিলে ?” গোরা কহিল, “না, আজ আমরা দুইজনেই পরেশবাবুর ওখানে গিয়েছিলুম।” শুনিয়া আনন্দময়ী চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওঁদের সকলের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে ?” গোরা কহিল, “হা, হয়েছে।” আনন্দময়ী। ওঁদের মেয়েরা বুঝি সকলের সাক্ষাতেই বেরোন ? গোরা । হা, ওঁদের কোনো বাধা নেই। অন্য সময় হইলে এরূপ উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনা প্ৰকাশ পাইত, আজ তাহার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া আনন্দময়ী আবার চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। পরদিন সকালে উঠিয়া গোরা অন্য দিনের মতো অবিলম্বে মুখ ধুইয়া দিনের কাজের জন্য প্রস্তুত হইতে গেল না। সে অন্যমনস্কভাবে তাহার শোবার ঘরের পূর্ব দিকের দরজা খুলিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। তাঁহাদের গলিটা পূর্বের দিকে একটা বড়ো রাস্তায় পড়িয়াছে; সেই বড়ো রাস্তার পূর্বপ্রান্তে একটা ইস্কুল আছে ; সেই ইস্কুলের সংলগ্ন জমিতে একটা পুরাতন জাম গাছের মাথার উপরে পাতলা একখণ্ড সাদা কুয়াশা ভাসিতেছিল এবং তাহার পশ্চাতে আসন্ন সূর্যোদয়ের অরুণরেখা ঝাপসা হইয়া দেখা দিতেছিল। গােরা চুপ করিয়া অনেকক্ষণ সেই দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে সেই ক্ষীণ কুয়াশটুকু মিশিয়া গেল, উজ্জ্বল রৌদ্র গাছের শাখার ভিতর দিয়া যেন অনেকগুলো ঝকঝকে সঙিনের মতো বিধিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং দেখিতে দেখিতে কলিকাতার রাস্ত জনতায় ও কোলাহলে १र्ष श्श्शा छैठेिल । এমন সময় হঠাৎ গলির মোড়ে অবিনাশের সঙ্গে আর-কয়েকটি ছাত্রকে তাহার বাড়ির দিকে আসিতে দেখিয়া গোরা তাহার এই আবেশের জালকে যেন এক প্রবল টানে ছিন্ন করিয়া ফেলিল ; সে নিজের মনকে একটা প্রচণ্ড আঘাত করিয়া বলিল— না, এসব কিছু নয় ; এ কোনােমতেই চলিবে না | বলিয়া দ্রুতবেগে শোবার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। গোরার বাড়িতে তাহার দলবল আসিয়াছে অথচ গোরা তাহার অনেক পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া নাই, এমন ঘটনা ইহার পূর্বে আর একদিনও ঘটতে পায় নাই। এই সামান্য ক্রটিতেই গােরাকে ভারি একটা ধিক্কার দিল ; সে মুনে মনে স্থির করিল আর সে পরেশবাবুর বাড়ি যাইবে না এবং বিনয়ের সঙ্গেও যাহাতে কিছুদিন দেখা না হইয়া এই সমস্ত আলোচনা বন্ধ থাকে সেইরূপ চেষ্টা করিবে । সেদিন নীচে গিয়া এই পরামর্শ হইল যে, গােরা তাহার দলের দুই-তিন জনকে সঙ্গে করিয়া পায়ে হাঁটিয়া গ্ৰণ্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়া ভ্রমণে বাহির হইবে ; পথের মধ্যে গৃহস্থবাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করিবে, সঙ্গে টীকাকড়ি কিছুই লইবে না। এই অপূর্ব সংকল্প মনে লইয়া গােরা হঠাৎ কিছু অতিরিক্ত পরিমাণে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। সমস্ত বাধীন ছেদন করিয়া এইরূপ খোলা রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িবার একটা প্ৰবল আনন্দ তাহাকে পাইয়া বসিল । ভিতরে ভিতরে তাহার হৃদয় যে একটা জালে জড়াইয়া পড়িয়ছে, এই বাহির হইবার কল্পনাতেই সেটা যেন ছিন্ন হইয়া গেল বলিয়া তাহার মনে হইল। এই সমস্ত ভাবের আবেশ যে মীয়মাত্র এবং কর্মই যে সত্য সেই কথাটা খুব জোরের সহিত নিজের মনের মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত *রিয়া লইয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া লইবার জন্য ইস্কুল-ছুটির বালকের মতো গোরা তাহার