পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ዒO রবীন্দ্র-রচনাবলী বিনয়বাবুর সঙ্গে আর কেহ আসিয়াছে কিনা, এ প্রশ্ন সুচরিতা আজ উচ্চারণ করিতেও পারিল না। যদি আর কেহ আসিত তবে নিশ্চয় ললিতা তাহার উল্লেখ করিত, কিন্তু তবু মন নিঃসংশয় হইতে পারিল না। আর সে নিজেকে দমনের চেষ্টা না করিয়া গৃহাগত অতিথির প্রতি কর্তব্যের উপলক্ষে বাহিরের ঘরের দিকে চলিল। ললিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই যাবি নে ?” ললিতা একটু অধৈর্যের স্বরে কহিল, “তুমি যাও-না, আমি পরে যাচ্ছি।” সুচরিতা বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, বিনয় সতীশের সঙ্গে গল্প করিতেছে। সুচরিতা কহিল, “বাবা বেরিয়ে গেছেন, এখনই আসবেন। মা আপনাদের সেই অভিনয়ের কবিতা মুখস্থ করাবার জন্যে লাবণ্য ও লীলাকে নিয়ে মাস্টারমশায়ের বাড়িতে গেছেন- ললিতা কোনোমতেই গেল না । তিনি বলে গেছেন, আপনি এলে আপনাকে বসিয়ে রাখতে- আপনার আজ পরীক্ষা হবে ।” বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি এর মধ্যে নেই ?” সুচরিতা কহিল, “সবাই অভিনেতা হলে জগতে দর্শক হবে কে ?” বরদাসুন্দরী সুচরিতাকে এ-সকল ব্যাপারে যথাসম্ভব বাদ দিয়া চলিতেন। তাই তাহার গুণাপনা দেখাইবার জন্য এবারও ডাক পড়ে নাই । অন্য দিন এই দুই ব্যক্তি একত্র হইলে কথার অভাব হইত না। আজ, উভয় পক্ষেই এমন বিঘ্ন ঘটিয়াছে যে, কোনোমতেই কথা জমিতে চাহিল না। সুচরিতা গোরার প্রসঙ্গ তুলিবে না পণ করিয়া আসিয়াছিল। বিনয়ও পূর্বের মতো সহজে গোরার কথা তুলিতে পারে না। তাহাকে ললিতা এবং হয়তো এ বাড়ির সকলেই গোরার একটি ক্ষুদ্র উপগ্রহ বলিয়া মনে করে, ইহাই কল্পনা করিয়া গোরার কথা তুলিতে সে বাধা পায় । অনেক দিন এমন হইয়াছে বিনয় আগে আসিয়াছে, গোরা তাহার পরে আসিয়াছে- আজও সেইরূপ ঘটিতে পারে ইহাই মনে করিয়া সুচরিতা যেন একপ্রকার সচকিত অবস্থায় রহিল। গোরা পাছে আসিয়া পড়ে এই তাহার একটা ভয় ছিল এবং পাছে না। আসে এই আশঙ্কাও তাঁহাকে বেদনা দিতেছিল । বিনয়ের সঙ্গে ছাড়া-ছাড়া ভাবে দুই-চারটে কথা হওয়ার পর সুচরিতা আর কোনো উপায় না। দেখিয়া সতীশের ছবির খাতাখানা লইয়া সতীশের সঙ্গে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে ছবি সাজাইবার ত্রুটি ধরিয়া নিন্দা করিয়া সতীশকে রাগাইয়া তুলিল। সতীশ অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বাদানুবাদ করিতে লাগিল। আর বিনয় টেবিলের উপর তাহার প্রত্যাখ্যাত করবীগুচ্ছের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া লজ্জায় ও ক্ষোভে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল যে, অন্তত ভদ্রতার খাতিরেও আমার এই ফুল কয়টা ললিতার লওয়া উচিত ছিল। হঠাৎ একটা পায়ের শব্দে চমকিয়া সুচরিতা পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, হারানবাবু ঘরে প্রবেশ করিতেছেন। তাহার চমকটা অত্যন্ত সুগোচর হওয়াতে সুচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল। হারানবাবু একটা চৌকিতে বসিয়া কহিলেন, “কই, আপনাদের গীেরবাবু আসেন নি ?” বিনয় হারানবাবুর এরূপ অনাবশ্যক প্রশ্নে বিরক্ত হইয়া কহিল, “কেন, তাকে কোনো প্রয়োজন আছে ?” হারানবাবু কহিলেন, “আপনি আছেন। অথচ তিনি নেই, এ তো প্রায় দেখা যায় না ; তাই জিজ্ঞাসা করছি।” বিনয়ের মনে বড়ো রাগ হইল- পাছে তাহা প্রকাশ পায় এইজন্য সংক্ষেপে কহিল, “তিনি কলকাতায় নেই।” হারান। প্রচারে গেছেন বুঝি ? বিনয়ের রাগ বাড়িয়া উঠিল, কোনো জবাব করিল না। সুচরিতাও কোনো কথা না বলিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। হারানবাবু দ্রুতপাদ সুচরিতার অনুবর্তন করিলেন, কিন্তু তাহাকে ধরিয়া উঠিতে