পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী SR8 এইরূপ স্থির হইয়াছিল যে, ইংরেজ কবি ড্রাইডেনের রচিত সংগীত-বিষয়ক একটি কবিতা বিনয় ভাবব্যক্তির সহিত আবৃত্তি করিয়া যাইবে এবং মেয়েরা অভিনয়মঞ্চে উপযুক্ত সাজে সজ্জিত হইয়া কাব্যলিখিত ব্যাপারের মুক অভিনয় করিতে থাকিবে। এ ছাড়া মেয়েরাও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি এবং গান প্রভৃতি করবে। বরদাসুন্দরী বিনয়কে অনেক ভরসা দিয়াছিলেন যে, তাহাকে তাহারা কোনোপ্রকারে তৈরি করিয়া লাইবেন । তিনি নিজে ইংরেজি অতি সামান্যই শিখিয়ছিলেন। কিন্তু তাহার দলের দুই-এক জন পণ্ডিতের প্রতি তাহার নির্ভর ছিল । কিন্তু যখন আখড়া বসিল, বিনয় তাহার আবৃত্তির দ্বারা বরদাসুন্দরীর পণ্ডিতসমাজকে বিস্মিত করিয়া দিল। তঁহাদের মণ্ডলীবহির্ভূত এই ব্যক্তিকে গড়িয়া লইবার সুখ হইতে বরদাসুন্দরী বঞ্চিত হইলেন। পূর্বে যাহারা বিনয়কে বিশেষ কেহ বলিয়া খাতির করে নাই তাহারা, বিনয় এমন ভালো ইংরেজি পড়ে বলিয়া তাহাকে মনে মনে শ্রদ্ধা না করিয়া থাকিতে পারিল না। এমন-কি, হারানবাবুও র্তাহার কাগজে মাঝে মাঝে লিখিবার জন্য তাহাকে অনুরোধ করিলেন । এবং সুধীর তাঁহাদের ছাত্রসভায় মাঝে মাঝে ইংরেজি বক্তৃতা করিবার জন্য বিনয়কে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল। ললিতার অবস্থাটা ভারি অদ্ভুত-রকম হইল। বিনয়কে যে কোনাে সাহায্য কাহাকেও করিতে হইল না। সেজন্য সে খুশিও হইল, আবার তাহাতে তাহার মনের মধ্যে একটা অসন্তোষও জন্মিল। বিনয় যে তাহাদের কাহারও অপেক্ষা নতুন নহে, বরঞ্চ তাহাদের সকলের চেয়ে ভালো, সে যে মনে মনে নিজের শ্ৰেষ্ঠত্ব অনুভব করিবে এবং তাঁহাদের নিকট হইতে কোনোপ্রকার শিক্ষার প্রত্যাশা করিবে না, ইহাতে তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল । বিনয়ের সম্বন্ধে সে যে কী চায়, কেমনটা হইলে তাহার মন বেশ সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল না। মাঝে হইতে তাহার অপ্রসন্নতা কেবলই ছোটােখাটাে বিষয়ে তীব্রভাবে প্রকাশ পাইয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়কেই লক্ষ্য করিতে লাগিল। বিনয়ের প্রতি ইহা যে সুবিচার নহে এবং শিষ্টতাও নহে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল ; বুঝিয়া সে কষ্ট পাইল এবং নিজেকে দমন করিতে যথেষ্ট চেষ্টা করিল, কিন্তু অকস্মাৎ অতি সামান্য উপলক্ষেই কেন যে তাহার একটা অসংগত অন্তরাজ্জ্বালা সংযমের শাসন লঙ্ঘন করিয়া বাহির হইয়া পড়িত তােহাসে বুঝিতে পারিত না। পূর্বে যে ব্যাপারে যোগ দিবার জন্য সে বিনয়কে অবিশ্রাম উত্তেজিত করিয়াছে এখন তাহা হইতে নিরস্ত করিবার জন্যই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কিন্তু এখন সমস্ত আয়োজনকে বিপর্যন্ত করিয়া দিয়া বিনয় অকারণে পলাতক হইবে কী বলিয়া ? সময়ও আর অধিক নাই ; এবং নিজের একটা নূতন নৈপুণ্য আবিষ্কার করিয়া সে নিজেই এই কাজে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে। অবশেষে ললিতা বরদাসুন্দরীকে কহিল, “আমি এতে থাকব না।” “কেন ?” ললিতা কহিল, “আমি যে পারি। নে ৷” বস্তুত যখন হইতে বিনয়কে আর আনাড়ি বলিয়া গণ্য করিবার উপায় ছিল না, তখন হইতেই ললিতা বিনয়ের সম্মুখে কোনোমতেই আবৃত্তি বা অভিনয় অভ্যাস করিতে চাহিত না । সে বলিত, “আমি আপনি আলাদা অভ্যাস করিব।” ইহাতে সকলেরই অভ্যাসে বাধা পড়িত, কিন্তু ললিতাকে কিছুতেই পারা গেল না। অবশেষে, হার মানিয়া অভ্যাসক্ষেত্রে ললিতাকে বাদ দিয়াই কাজ চালাইতে श्न । কিন্তু যখন শেষ অবস্থায় ললিতা একেবারেই ভঙ্গ দিতে চাহিল তখন বরদাসুন্দরীর মাথায় বজ্ৰাঘাত হইল। তিনি জানিতেন যে র্তাহার দ্বারা ইহার প্রতিকার হইতেই পরিবে না। তখন তিনি পরেশবাবুর শরণাপন্ন হইলেন। পরেশবাবু সামান্য বিষয়ে কখনোই তাহার মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে তাহারা প্রতিশ্রুত হইয়াছেন, সেই অনুসারে সে পক্ষও