পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8br○ শেষ না হইতেই জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুর পাড়া কত দূরে আছে ?” নাপিত কহিল, “ক্রোশ-দেড়েক দূরে যে নীলকুঠির কাছারি, তার তহসিলদার ব্ৰাহ্মণ, নাম মাধব 亦巧门 গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “স্বভাবটা ?” নাপিত কহিল, “যমদূত বললেই হয়। এত বড়ো নির্দয় অথচ কৌশলী লোক আর দেখা যায় না। এই যে কদিন দারোগাকে ঘরে পুষিছে তার সমস্ত খরচা আমাদেরই কাছ থেকে আদায় করবে- তাতে কিছু মুনফাও থাকবে ।” রমাপতি কহিল, “গীেরবাবু, চলুন, আর তো পারা যায় না।” বিশেষত নাপিত-বউ যখন মুসলমান । ছেলেটিকে তাহাদের প্রাঙ্গণের কুয়াটার কাছে দাঁড় করাইয়া ঘটিতে করিয়া জল তুলিয়া স্নান করাইয়া দিতে লাগিল তখন তাহার মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল এবং এ বাড়িতে বসিয়া থাকিতে তাহার প্রবৃত্তিই হইল না। গোরা যাইবার সময় নাপিতকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই উৎপাতের মধ্যে তুমি যে এ পাড়ায় এখনাে টিকে আছ ? আর কোথাও তোমার আত্মীয় কেউ নেই ?” নাপিত কহিল, “অনেক দিন আছি, এদের উপর আমার মায়া পড়ে গেছে। আমি হিন্দু নাপিত, আমার জোতজমা বিশেষ কিছু নেই বলে কুঠির লোক আমার গায়ে হাত দেয় না। আজ এ পাড়ার পুরুষ বলতে আর বড়ো কেউ নেই, আমি যদি যাই তা হলে মেয়েগুলো ভয়েই মারা যাবে।” গোরা কহিল, “আচ্ছা, খাওয়া-দাওয়া করে আবার আমি আসব।” দারুণ ক্ষুধাতৃষ্ণার সময় এই নীলকুঠির উৎপাতের সুদীর্ঘ বিবরণে রমাপতি গ্রামের লোকের উপরেই চটিয়া গেল। বেটারা প্রবলের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে চায় ইহা গোয়ার মুসলমানের স্পর্ধা ও নিবৃদ্ধিতার চরম বলিয়া তাহার কাছে মনে হইল। যথােচিত শাসনের দ্বারা ইহাদের এই ঔদ্ধত্য চূৰ্ণ হইলেই যে ভালো হয়। ইহাতে তাহার সন্দেহ ছিল না । এই প্রকারের লক্ষ্মীছাড়া বেটাদের প্রতি পৃলিসের উৎপাত ঘটিয়াই থাকে এবং ঘটিতেই বাধ্য এবং ইহারাই সেজন্য প্রধানত দায়ী এইরূপ তাহার ধারণা | মনিবের সঙ্গে মিটমাট করিয়া লইলেই তো হয়, ফেসাদ বাধাইতে যায় কেন, তেজ এখন রহিল কোথায় ? বস্তুত রমাপতির অন্তরের সহানুভূতি নীলকুঠির সাহেবের প্রতিই ছিল। মধ্যাহ্নরৌদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়া চলিতে চলিতে গোরা সমস্ত পথ একটি কথাও বলিল না । অবশেষে গাছপালার ভিতর হইতে কাছারিবাড়ির চালা যখন কিছুদূর হইতে দেখা গেল তখন হঠাৎ গোরা আসিয়া কহিল, “রমাপতি, তুমি খেতে যাও, আমি সেই নাপিতের বাড়ি চললুম।” রমাপতি কহিল, “সে কী কথা ! আপনি খাবেন না ? চাটুজের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে তার পরে যাবেন ।” গোরা কহিল, “আমার কর্তব্য আমি করব, এখন তুমি খাওয়া-দাওয়া সেরে কলকাতায় চলে যেয়ো— ঐ ঘোষপুর-চারে আমাকে বোধ হয় কিছুদিন থেকে যেতে হবে— তুমি সে পারবে না।” রমাপতির শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল। গোরার মতো ধর্মপ্ৰাণ হিন্দু ঐ স্নেচ্ছের ঘরে বাস করিবার কথা কোন মুখে উচ্চারণ করিল। তাই সে ভাবিয়া পাইল না। গোরা কি পানভোজন পরিত্যাগ করিয়া । প্রয়োপবেশনের সংকল্প করিয়াছে তাই সে ভাবিতে লাগিল । কিন্তু তখন ভাবিবার সময় নহে, এক-এক মুহূর্ত তাহার কাছে এক-এক যুগ বলিয়া বােধ হইতেছে ; গোরার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় পলায়নের জন্য তাহাকে অধিক অনুরোধ করিতে হইল না। ক্ষণকালের জন্য রমাপতি চাহিয়া দেখিল, গোরার সুদীর্ঘ দেহ একটি খর্ব ছায়া ফেলিয়া মধ্যাহ্নের খররৌদ্রে জনশূন্য তপ্ত বালুকার মধ্য দিয়া একাকী ফিরিয়া চলিয়াছে । ক্ষুধায় তৃষ্ণায় গােরাকে অভিভূত করিয়াছিল, কিন্তু দুৰ্বত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের অন্ন খাইয়া তবে জাত বঁাচাইতে হইবে, এ কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল ততই তাহার অসহ্য বোধ হইল । তাহার মুখ-চোখ লাল ও মাথা গরম হইয়া মনের মধ্যে বিষম একটা বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। সে