পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brや রবীন্দ্র-রচনাবলী বাড়িতে গত পূজার দিন যাত্রায় যে দুই ছােকরা ভিত্তি ও মেথরানি সাজিয়াছিল তাঁহাদের অভিনয়ে তিনি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং তাহার অনুরোধক্রমে একাধিক বার তাহাদের অংশ র্তাহার সম্মুখে পুনরাবৃত্ত হইয়াছিল। র্তাহার স্ত্রী মিশনারির কন্যা ছিলেন । তাহার বাড়িতে মাঝে মাঝে মিশনারি মেয়েদের চা-পান-সভা বসিত। জেলায় তিনি একটি মেয়ে-ইস্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন এবং যাহাতে সে স্কুলে ছাত্রীর অভাব না হয়। সেজন্যে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন। পরেশবাবুর বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষার চর্চা দেখিয়া তিনি তাহাদিগকে সর্বদা উৎসাহ দিতেন ; দূরে থাকিলেও মাঝে মাঝে চিঠিপত্র চালাইতেন ও ক্রিসমাসের সময় তাহাদিগকে ধর্মগ্রন্থ উপহার পাঠাইতেন। মেলা বসিয়াছে। তদুপলক্ষে হারানবাবু সুধীর ও বিনয়ের সঙ্গে বরদাসুন্দরী ও মেয়েরা সকলেই আসিয়াছেন— তাহাদিগকে ইনস্পেকশন-বাংলায় স্থান দেওয়া হইয়াছে। পরেশবাবু এই সমস্ত গোলমালের মধ্যে কোনোমতেই থাকিতে পারেন না, এইজন্য তিনি একলা কলিকাতাতেই রহিয়া গিয়াছেন। সুচরিতা তাহার সঙ্গরক্ষার জন্য র্তাহার কাছে থাকিতে অনেক চেষ্টা পাইয়াছিল, কিন্তু পরেশ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণে কর্তব্যপালনের জন্য সুচরিতাকে বিশেষ উপদেশ দিয়াই পঠাইয়া দিলেন। আগামী পরশ্ব কমিশনার সাহেব ও সস্ত্রীক ছোটােলাটের সম্মুখে ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়িতে ডিনারের পরে ঈভূনিং পাটিতে পারেশবাবুর মেয়েদের দ্বারা অভিনয় আবৃত্তি প্রভৃতি হইবার কথা স্থির হইয়াছে। সেজন্য ম্যাজিষ্ট্রেটের অনেক ইংরেজ বন্ধু জেলা ও কলিকাতা হইতে আহুত হইয়াছেন। কয়েকজন বাছা বাছা বাঙালি ভদ্রলোকেরও উপস্থিত হইবার আয়োজন হইয়াছে। তাহদের জন্য বাগানে একটি র্তাবুতে ব্ৰাহ্মণ পাচক -কর্তৃক প্রস্তুত জলযোগেরও ব্যবস্থা হইবে এইরূপ শুনা যাইতেছে। হারানবাবু অতি অল্পকালের মধ্যেই উচ্চভাবের আলাপে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবকে বিশেষ সন্তুষ্ট করিতে গিয়াছিলেন এবং খৃস্টান ধর্ম গ্রহণে তিনি অল্প একটুমাত্র বাধা কেন রাখিয়াছেন এই প্রশ্নও হারানবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। আজ অপরাহুে নদীতীরের পথে হারানবাবুর সঙ্গে তিনি ব্ৰাহ্মসমাজের কার্যপ্ৰণালী ও হিন্দুসমাজের সংস্কারসাধন সম্বন্ধে গভীরভাবে আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন। এমন সময় গোরা “গুড ঈভনিং সার" বলিয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া দাড়াইল । কাল সে ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত দেখা করিবার চেষ্টা করিতে গিয়া বুঝিয়াছে যে সাহেবের চৌকাঠ উত্তীর্ণ হইতে গেলে তাহার পেয়াদার মাশুল জোগাইতে হয় | এরূপ দণ্ড ও অপমান স্বীকার করিতে অসম্মত হইয়া আজ সাহেবের হাওয়া খাইবার অবকাশে সে তাহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে। এই সাক্ষাৎকালে হারানবাবু ও গোরা উভয় পক্ষ হইতেই পরিচয়ের কোনাে লক্ষণ প্রকাশ হইল না। লোকটাকে দেখিয়া সাহেব কিছু বিস্মিত হইয়া গেলেন। এমন ছয় ফুটের চেয়ে লম্বা, হাড়-মোটা, মজবুত মানুষ তিনি বাংলা দেশে পূর্বে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। ইহার দেহের বর্ণও সাধারণ বাঙালির মতো নহে। গায়ে একখানা খাকি রঙের পাঞ্জাবি জামা, ধুতি মোটা ও মলিন, হাতে একগাছা বীশের লাঠি, চাদরখানাকে মাথায় পাগড়ির মতাে বাধিয়াছে। গোরা ম্যাজিষ্ট্রেটকে কহিল, “আমি চর-ঘোষপুর হইতে আসিতেছি।” ম্যাজিষ্ট্রেট একপ্রকার বিস্ময়সূচক শিস দিলেন। ঘোষপুরের তদন্তকার্যে একজন বিদেশী বাধা দিতে আসিয়াছে সে সংবাদ তিনি গতকালই পাইয়াছিলেন। তবে এই লোকটাই সে ! গোরাকে আপাদমস্তক তীক্ষভাবে একবার নিরীক্ষণ করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কোন জাত ?” গোরা কহিল, “আমি বাঙালি ব্ৰাহ্মণ ।” সাহেব কহিলেন, “ও ! খবরের কাগজের সঙ্গে তোমার যোগ আছে বুঝি ?” গোরা কহিল, “না ? মাজিষ্ট্রেট কহিলেন, “তবে ঘোষপুর-চাের তুমি কী করতে এসেছ ?”